২০০৬ সালে রাজধানীতে ভবন ছিল ১১ লাখ। ২০১৬ সালে তা ২২ লাখে পৌঁছে বলে জানায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক)। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো জরিপ করেনি সংস্থাটি। এই সাত বছরে আরও কত সংখ্যক ভবন রাজধানীতে তৈরি হয়েছে তা বলা কঠিন। এর মধ্যে সিংহভাগ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়মনীতির ব্যত্যয় ঘটেছে। ফলে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি বাড়ছে। এসব বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ না নিলে অগ্নিদুর্ঘটনা, ভবন ধস ও ভূমিকম্পের মতো ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব নয়।

সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে রাজধানীতে গড়ে ওঠা ভবনগুলোর অবকাঠামো নিরূপণ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ তদারকি, ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ভবন নির্মাণে ব্যত্যয় পাওয়া গেলে ব্যবস্থা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া, আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে মনিটরিং এবং এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগসহ নানা পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে রাজউক। রাজধানীর স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সংস্থাটি।

রাজধানীতে গড়ে ওঠা ভবনগুলোর অবকাঠামো নিরূপণ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ তদারকি, ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ভবন নির্মাণে ব্যত্যয় পাওয়া গেলে ব্যবস্থা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া, আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে মনিটরিং এবং এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগসহ নানা পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে রাজউক

রাজধানীর সব ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে কার্যবিধি প্রণয়ন করতে রাজউক চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে নয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ কমিটি সভা করে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কমিটিতে রাজউক চেয়ারম্যান ছাড়াও রয়েছেন রাজউকের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সদস্য, পরিকল্পনা  সদস্য, নগর পরিকল্পনাবিদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স প্রতিনিধি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট প্রতিনিধি, স্থপতি ইনস্টিটিউট প্রতিনিধি ও আরবান রেজিলিয়েন্স-এর প্রকল্প পরিচালক।

আরও পড়ুন >> ৪৫ বছর আগের ভবন : ‘আবাসিক’ নাকি ‘বাণিজ্যিক’ জানে না রাজউক

রাজধানীতে এত ভবনের ভিড়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সঠিক সংখ্যা জানে না রাজউক। দুর্যোগ মোকাবিলায় ২০১৫ সালে নতুন স্থাপনা নির্মাণে গুণগত মান উন্নয়নে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প চালু হয়। এর মাধ্যমে রাজধানীর মাটি পরীক্ষা করে রাজউক জানতে পারে ঢাকা ও আশপাশের ৬৫ শতাংশ এলাকার ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে বালু দিয়ে ভরাট করা জায়গায় যেসব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেসব ভবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

২০১৮ সালে রাজউকের এক জরিপ মতে, ধানমন্ডির প্রায় ৮৯ শতাংশ ভবন রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। একইভাবে খিলগাঁও, মতিঝিল ও রামপুরার ৯৭ শতাংশ ভবন নির্মাণ হয়েছে রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে। অন্যদিকে পল্লবী, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভবন নির্মাণ হয়েছে নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে

অন্যদিকে, ২০১৮ সালে রাজউকের এক জরিপ মতে, ধানমন্ডির প্রায় ৮৯ শতাংশ ভবন রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। একইভাবে খিলগাঁও, মতিঝিল ও রামপুরার ৯৭ শতাংশ ভবন নির্মাণ হয়েছে রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে। অন্যদিকে পল্লবী, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভবন নির্মাণ হয়েছে নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে।

নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে রাজধানীতে লাখ লাখ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব তদারকি করতে রাজউকের বিভিন্ন জোনে মাত্র ২৩০ জন ইমারত পরিদর্শক আছেন। যা দিয়ে ভবন তদারকি করা রাজউকের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তাই ভবনগুলোর অবকাঠামো নিরূপণ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি করতে আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।

জানা গেছে, রাজধানীর ভবন নির্মাণ তদারকিতে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগ দেওয়া হলে তারাই মূলত ভবনগুলো নির্মাণে নকশার ব্যত্যয় ঘটছে কি না, সঠিক নিয়মে বা উল্লিখিত নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ হচ্ছে কি না, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত, পার্কিং ব্যবস্থাসহ সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়গুলোর দিকে নজরদারি করবে। এজন্য অবশ্য মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হচ্ছে রাজউককে। যদিও নিরাপত্তা নিশ্চিতে যা যা করণীয়, তা পালনে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন >> গায়েব হওয়া ২৬ হাজার নথি উদ্ধার : হাইকোর্টকে জানাল রাজউক

এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর ভবনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সংস্থাটি। ভবনগুলোর অবকাঠামো নিরূপণ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ তদারকিসহ আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে মনিটরিং করতে তৃতীয় পক্ষ নিয়োগসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশাল এ শহরে এত এত ভবন, আবার নির্মাণাধীন ভবন, এগুলো পরিদর্শন করা স্বল্প জনবল নিয়ে সম্ভব নয়। আবার নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশা ঠিক মতো মানা হচ্ছে না। তাই আমরা ভবনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ভবন নির্মাণ তদারকি করতে আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে থার্ড পাটি নিয়োগ করব। যার মাধ্যমে ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)- র নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজউকের আওতাধীন এলাকায় নিয়ম ও নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে বহু ভবন নির্মিত ও নির্মাণ হচ্ছে, যা সবার জন্য অনিরাপদ। এ ব্যর্থতা রাজউকের। কারণ, নগর পরিকল্পনা, উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ ও ভবনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাজউকের দায়িত্ব। তাই তাদের কাজগুলোতে যেন কোনো ব্যর্থতা না থাকে সেজন্য তাদের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি এবং এটা তাদের দায়িত্ব। রাজধানীর ভবনগুলোর অবকাঠামো নিরূপণ ও নির্মাণাধীন ভবনের কাজ যদি তারা সঠিকভাবে তদারকি করতে পারে বা করিয়ে নিতে পারে তাহলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন >> রাজউকের প্লট বিক্রিতে গোপন সমঝোতা, গচ্চা শত কোটি টাকা!

এদিকে, রাজউকের আওতাধীন সরকারি, ডেভেলপার ও ব্যক্তি পর্যায়ের ভবনগুলোর বেজমেন্ট মার্কেট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেসব ভবনের বেজমেন্ট মার্কেট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে সেগুলোর তালিকা করছে রাজউক। রাজউকের আওতাধীন আটটি জোনে সরকারি, ডেভেলপার ও ব্যক্তি পর্যায়ে কতগুলো ভবনের বেজমেন্ট মার্কেট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এ তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তালিকা প্রণয়নের জন্য রাজউকের আটটি জোনে আলাদা আটটি কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি।

অন্যদিকে, ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নির্মিত ভবনের বেশির ভাগই অনুমোদনহীন। এসব ভবন নিয়ে কী করা যায়, এমন ভাবনা থেকে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে রাজউক। অনুমোদনহীন এসব ভবন জরিমানা দিয়ে বৈধ করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি। উচ্চ হারে জরিমানা নিয়ে এসব ভবন বৈধ করার সুপারিশ করা হয়েছে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ ২০২২-৩৫)।

আরও পড়ুন >> ২৮ বছরেও নেই নাগরিক সুবিধা, পূর্বাচলে বাড়ি বানাচ্ছে না কেউ

এ বিষয়ে ডিটেল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী যদি কোনো অনুমোদনহীন ভবন অবকাঠামোগতভাবে নিরাপদ হয়, সেক্ষেত্রে জরিমানা দিয়ে বৈধতা পাওয়ার বিধান আছে। অর্থাৎ কোনো ভবন যদি রাজউকের অনুমোদন না নিয়ে থাকে, কিন্তু ভবনটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি ঠিক থাকে সেক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে জরিমানার বিধান রয়েছে। এ অবস্থায় ড্যাপের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকলে কেবল সেই ভবনকে অনুমোদন দেওয়া হবে। অন্যথায় অনুমোদন পাবে না। তবে সরকারি জমি, নদী, খাল ও জলাভূমি দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা কখনোই অনুমোদন পাবে না। সেটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা যতই ভালো থাকুক না কেন। এসব বিষয়ে মূলত বিধিমালা জারি করা হবে।

এএসএস/ওএফ/এমএআর