অনুসন্ধানে দুদক
দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ৯৭২ প্রপার্টি, তালিকায় আছেন আরাভ খানও
বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দুবাইয়ের সম্পদ গড়েছেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। গোল্ডেন ভিসায় ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশিদের মালিকানায় ৯৭২টি সম্পদ ক্রয়ের তথ্য ফাঁস হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সি৪এডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি এমন আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রকাশ করেছে। যার সূত্র ধরেই হাইকোর্টের নির্দেশনায় অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে তিন সদস্যের টিম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করেছে।
বিজ্ঞাপন
>> বুর্জ খলিফার ২০০ কোটির ফ্ল্যাটে কী আছে?
যদিও দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগে দুবাইয়ে প্রপার্টি ক্রয়কারী বাংলাদেশির সংখ্যা আরও ৯০ জন বেশি। দুদকের অভিযোগ বলছে ৫৪৯ জন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ সুইস ব্যাংকসহ বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে পাচার করা হয়। পরবর্তীতে দুবাইয়ে স্থানান্তর করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গোল্ডেন ভিসা সুবিধায় প্রপার্টি ক্রয় করেছে। অর্থাৎ অভিযোগে আরও বেশ কিছু নাম সংযুক্ত হয়েছে। তবে, কারা কারা ওই তালিকায় রয়েছে সেটা নিশ্চিত করেনি দুদক।
তবে সংস্থাটির অন্য একটি ঊর্ধ্বতন সূত্র বলছে, তালিকায় আলোচিত আরাভ খানসহ তার পেছনের পৃষ্ঠপোষকদের নামও রয়েছে। যাদের মাধ্যমের খুনের আসামি হয়েও বিদেশ গমন, দুবাইয়ের রেসিডেন্স ভিসা প্রাপ্তি ও অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন আরাভ খান। যদিও এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করতে রাজি নয় দুদকের কোনো কর্তা ব্যক্তি। তাদের বক্তব্য হলো, যার নামই থাকুক দুদকের প্রথম কাজ হলো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা।
>> মুরগি চুরি করে ছেড়েছিলেন গ্রাম, হত্যা মামলায় দেশ ছাড়েন ‘আরাভ খান’
মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার ও দুবাইয়ে সম্পদ ক্রয় সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার ও দুবাইয়ে গোন্ডেন ভিসার আওতায় সেই টাকা দিয়ে সম্পদ ক্রয়ের একটি অভিযোগ আমাদের কাছে আছে। এ অভিযোগ পাওয়ার পর কমিশন যাচাই-বাছাই শেষে মনে করেছে যে, অনুসন্ধান হওয়া দরকার। যেহেতু এটা অনেক বড় অভিযোগ সে কারণে তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। ওই টিম কাজ শুরু করেছে। অনুসন্ধান কাজ শেষ হলে যে তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাবে, তার মধ্যে মামলা করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে অনুসন্ধান কর্মকর্তারা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য নথিপত্র চাওয়া শুরু করেছে।
দুবাইয়ে সম্পদ ক্রয়ের সত্যতা যাচাইয়ে দুদক টিম পাঠাবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনুসন্ধানের স্বার্থে বিদেশে যেতে বাধা নেই। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অনুসন্ধান টিম যদি মনে করে দুবাইয়ে যাওয়া প্রয়োজন, তাহলে কমিশনের অনুমতি নিয়ে অবশ্যই সেটা করতে পারবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এ মুহূর্তে না নেই। আমাদের কাছে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নয়, ব্যক্তি যেই হয়ে থাকুক না কেন আমাদের কাজ হবে বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান করে অর্থপাচারকারীকে খুঁজে বের করা এবং ব্যবস্থা নেওয়া।
প্রসঙ্গত, পুলিশ পরিদর্শক হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত ৮নং আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারীও। ২০২০ সালে রবিউল ভারতের পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। ওই বছরের ২৮ জুলাই কলকাতা থেকে ইস্যু করা পাসপোর্টে রবিউলের নাম আরাভ খান হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তার বাবার নাম জাকির খান ও মা রেহানা বিবি খান বলে উল্লেখ করা হয়। পাসপোর্টের মেয়াদ ২০৩০ সালের ২৭ জুলাই শেষ হবে। আরব আমিরাত সরকার ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর তাকে রেসিডেন্ট পারমিট দেয়।
>> ৭ম শ্রেণির গণ্ডি না পেরোনো আপন আজ দুবাইয়ের ‘আরাভ খান’
অভিযোগের বিষয়ে দুদকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ্যে-গোপনে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হচ্ছে দুবাইয়ে। এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগে ফুলে ফেঁপে উঠছে দুবাইয়ের আর্থিক, ভূসম্পত্তি, আবাসনসহ (রিয়েল এস্টেট) বিভিন্ন খাত। ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪৫৯ জন বাংলাদেশিদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য রয়েছে। কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। তবে প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পত্তি কিনতে ক্রেতাদের ব্যয়ের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতে পারে।
অভিযোগ সূত্র বলছে, গত দুই বছরে দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের প্রপার্টি ক্রয়ের প্রবণতা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছে বাংলাদেশিরা, যার তথ্য তারা দেশে পুরোপুরি গোপন করেছেন। এমনকি বৈশ্বিক নেতিবাচক অর্থনীতির মধ্যেও দেশটির রিয়েল এস্টেট খাতের বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষে। এদিক থেকে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, চীন ও জার্মানির মতো দেশগুলোর বাসিন্দাদের পেছনে ফেলে দিয়েছেন বাংলাদেশিরা। ২০২০ সালে করোনার মধ্যেই দেশের নির্মাণ খাতের ঠিকাদারির সঙ্গে যুক্ত একজন ব্যবসায়ী দুবাই চলে যান। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। দেশের ব্যবসা থেকে উপার্জিত মুনাফা প্রতিনিয়ত দুবাইয়ে স্থানান্তর করছেন তিনি।
>> পুলিশ হত্যা মামলার আসামির দোকান উদ্বোধনে দুবাইয়ে সাকিব
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এখন যেকোনোভাবে হোক বিদেশ থেকে পুঁজির প্রবাহ বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে। এজন্য বিদেশি ধনীদের স্থানান্তরিত হতে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দিচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশও অর্থপাচার প্রতিরোধে কার্যকর ও শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা গড়তে না পারায় এখান থেকে দুবাইয়ে অর্থপাচার বেড়েছে। ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির হিসাব অনুযায়ী, দুবাইয়ে মোট প্রপার্টির বাজার ব্যাপ্তি ৫৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে ২৭ শতাংশ আছে বিদেশি মালিকানায়।
দুবাইয়ের গোল্ডেন ভিসার প্রক্রিয়া কেমন
সংযুক্ত আরব আমিরাত কোনো স্পনসরশিপ ছাড়াই গোল্ডেন ভিসার জন্য আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। কাজ, বসবাস ও পড়াশোনার জন্য এমন সুবিধা পাওয়া যায়। আমিরাত বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন ভিসা দেয়। মূলত দক্ষ কর্মী ও বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতেই এই ভিসা দেয় দেশটি। বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, সরকারি কাজে বিনিয়োগকারী, আবাসন খাতে বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা, উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফলকারী, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা অন্যান্য দেশের স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা এই ভিসার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান।
দুবাইয়ের রেসিডেন্সি অ্যান্ড ফরেনার্স অ্যাফেয়ার্সের জেনারেল ডিরেক্টরেটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত গোল্ডেন ভিসা ইস্যু করা হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৬টি। সম্প্রতি গোল্ডেন ভিসা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মাসিক আয়ও ৫০ হাজার দিরহাম থেকে কমিয়ে ৩০ হাজার দিরহাম করা হয়েছে। এর ফলে, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, প্রকৌশল, তথ্য প্রযুক্তি, ব্যবসা প্রশাসন, শিক্ষা, আইনের মতো আরও অনেক ক্ষেত্রে কর্মরতদের এই ভিসা পাওয়া সহজ।
>> অবশেষে আরাভ খানের নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক গণমাধ্যম গালফ বিজনেস ও খালিজ টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল অথরিটি ফর আইডেন্টিটি, ন্যাশনালিটি, কাস্টমস অ্যান্ড পোর্ট সিকিউরিটি ১০ বছরের গোল্ডেন ভিসার জন্য আবেদনের ক্ষেত্রে এন্ট্রি পারমিট ফি সংশোধন করেছে। ৬ মাসের এন্ট্রি পারমিটের জন্য পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ২৫০ দিরহাম। এই খরচের মধ্যে ১ হাজার দিরহাম ভিসা ইস্যু ফি, ১০০ দিরহাম আবেদন ফি, ১০০ দিরহাম স্মার্ট পরিষেবা ফি, ২৮ দিরহাম ইলেকট্রনিক পরিষেবা ফি এবং ২২ দিরহাম ফেডারেল কর্তৃপক্ষের ফি।
এন্ট্রি পারমিটের জন্য আবেদন করার সময় গোল্ডেন ভিসার আবেদনকারীদের অবশ্যই পাসপোর্ট, এক কপি রঙিন ছবি ও তিনি যে এই ভিসার জন্য আবেদন করার যোগ্য, সেই বিষয়ে প্রমাণসহ আরও কিছু নথি জমা দিতে হয়। http://smartservices.icp.gov.ae ওয়েবসাইট থেকে জেনে নেওয়া যাবে যে আবেদনকারী গোল্ডেন ভিসার জন্য উপযুক্ত কি-না। গোল্ডেন ভিসাপ্রাপ্তরা তাদের পরিবারের যেকোনো বয়সী সদস্যদের আমিরাতে নিয়ে যেতে পারেন।
আবাসন খাতে বিনিয়োগকারীরা অন্তত ২০ লাখ দিরহাম মূল্যের সম্পত্তি কিনে আরব আমিরাতের গোল্ডেন ভিসা পেতে পারেন। এছাড়া দেশটিতে নিবন্ধিত কোনো রাজস্ব আয়কারী স্টার্টআপের মালিক হলে বা অংশীদার হলেও উদ্যোক্তারা এই ভিসা পেতে পারেন।
আরএম/ওএফ