চীনের উদ্যোগে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে চায় মিয়ানমার। তাদের আগ্রহে আপত্তি নেই বাংলাদেশের। তবে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ কিছু শর্ত দিতে চায় ঢাকা। এর মধ্যে আছে পরবর্তীতে দ্রুত দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসন শুরুর নিশ্চয়তা।

এবার বেশ সক্রিয় চীন। প্রত্যাবাসন ইস্যুতে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করার বার্তা দিয়েছে দেশটি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে নেইপিদোর জন্য কোনো বার্তা আছে কি না, তাও জানতে চেয়েছে চীন।

কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে এবার বেশ সক্রিয় চীন। উদ্যোগী বেইজিংয়ের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রত্যাবাসন ইস্যুতে সিরিজ বৈঠক করেছেন। প্রত্যাবাসন ইস্যুতে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করার বার্তা দিয়েছে দেশটি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে নেইপিদোর জন্য কোনো বার্তা আছে কি না, তাও জানতে চেয়েছে চীন।

ঢাকার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত ওয়েনকে জানানো হয়েছে, জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে চায় না বাংলাদেশ। তবে পাইলট প্রকল্পের পরবর্তীতে দ্রুত দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসন শুরুর নিশ্চয়তা দিতে হবে। এছাড়া রাখাইনে রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে আসিয়ান ও জাতিসংঘকে যুক্ত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে ঢাকা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার আগ্রহ দেখাচ্ছে। চীনও বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী। এটা নিয়ে চীন উদ্যোগী হয়ে কাজ করছে। চীন কীভাবে সাহায্য করতে পারে সেটি জানতে চেয়েছে। কোনো ধরনের সাহায্য লাগলে তারা করতে রাজি আছে।

তিনি বলেন, মিয়ানমার প্রস্তুত রোহিঙ্গাদের নেওয়ার জন্য। আমরা এখনো সিদ্ধান্তের কথা জানাইনি।

আরও পড়ুন <<<->>> ভিয়েতনামকে আরও সক্রিয় ভূমিকায় দেখতে চায় বাংলাদেশ

মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা দরকার। এটা নিয়ে কাজ করা দরকার। তবে কিছু বিষয়ে নিশ্চয়তা চায় বাংলাদেশ। কিছু রোহিঙ্গা যাওয়ার পর আর গেল না, সেটা হবে না। আবার পাইলট প্রজেক্টের আওতায় যারা যাবে তারা আবার ফিরে চলে আসবে এমনটাও যেন না হয়। মিয়ানমার চায় প্রত্যাবাসন শুরু হোক। আমাদের কথা হচ্ছে, জোর করে কাউকে পাঠানো হবে না। স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরির নিশ্চয়তা মিয়ানমারকে দিতে হবে।

‘পাইলট প্রকল্পের পর দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন শুরুর নিশ্চয়তা দিতে হবে। রাখাইনে মানবাধিকার কর্মীরা যুক্ত থাকবে কি না? আসিয়ান ও জাতিসংঘকে সেখানে যুক্ত করা হবে কি না- এসব নিশ্চয়তা দিতে হবে। আমাদের বার্তা হচ্ছে, মিয়ানমার টিম পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত করুক, এরপর প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে। আর না হলে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটা চলমান থাকুক’-- যোগ করেন এ কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন - ৫০০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করল মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল

সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের যাচাই-বাছাই করা ৪৮০ জন রোহিঙ্গা এবং আগের যাচাই করা ৭৫০ জন রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন করতে চায় নেইপিদো। অর্থাৎ ১ হাজার ২৩০ জন রোহিঙ্গা দিয়ে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় দেশটি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করাটা খুবই জরুরি। তবে এতে মিয়ানমারের নতুন কোনো ফাঁদ আছে কি না তা তথ্যগত দিক থেকে যাচাই-বাছাই করতে হবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সংখ্যা, পরবর্তী প্রত্যাবাসনের সময় নির্ধারণ এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের খরচের বিষয়টি পরিষ্কার করে নিতে হবে।

চীনের নেপথ্য ভূমিকায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

পরবর্তীতে চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। ওই সময় রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানায় রোহিঙ্গারা। ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে তারা। প্রায় ছয় বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবধান থাকা দরকার। কারণ হচ্ছে জোর করে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। আর এটা বাংলাদেশ করবেও না। যে কারণে সাবধান থাকা উচিত সেটা হলো, এটা যেন কোনো ফাঁদ না হয় আবার। কিছু নিল বা কয়েক হাজার নিয়ে বিশ্বকে দেখাল, আমি তো নিয়েছি। নিয়ে বন্ধ করে দিল, জাতিসংঘ থাকল না-  এসব বিষয় দেখতে হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এ অধ্যাপকের ভাষ্য, চীন যদি জড়িত থাকে, বিশেষ করে নিরাপত্তার বিষয়ে, নিশ্চয়ই তারা ওই কাঠামোর কথা চিন্তা করছে। তারপরও বাংলাদেশের ভালো তথ্য জানা দরকার, ফাঁদে যেন না পড়ে যায়। সচেতন থাকা দরকার। চায়না এটার সঙ্গে একেবারে গ্যারেনটেড হিসেবে থাকবে, তা স্পষ্ট করে নিতে হবে। আমি মনে করি, সরকার এ ব্যাপারে সচেতন থাকবে। সংখ্যা থেকে শুরু করে টাইম ফ্রেম, কিংবা নিরাপত্তা ও খরচ- সবকিছু বিবেচনা করে এবং রোহিঙ্গাদের কনসার্ন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকার সমালোচনা করেন ইমতিয়াজ আহমেদ। তার ভাষায়, আমি একেবারে পাঠাব না, এটাও তো হতে পারে না। বাংলাদেশ বছরের পর বছর রোহিঙ্গাদের রেখে দেবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুধু বলবে; এখনও পাঠানোর পরিস্থিতি হয়নি। তারা তো কিছুই করছে না। তারা তো মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে যাচ্ছে। তারা বড় আকারে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিচ্ছে না। যে চাপ রাশিয়ার ওপর দিয়েছে তার অর্ধেক চাপ মিয়ানমারের ওপর দিলে মিয়ানমার রাজি হয়ে যেত এতদিনে। সেখানে তারা তা করছে না।

ঢাকা ও নেইপিদোর সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমারে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সামরিক জান্তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক চাপ এবং জান্তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে গত কয়েক মাসে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করছে বেইজিং। তারই ফলস্বরূপ প্রথমবারের মতো গত মাসের শুরুর দিকে চীনসহ আসিয়ান জোটের আটজন দূতকে রাখাইনের মংডু এবং সিটুওয়েক প্রত্যাবাসন শিবিরগুলো সরেজমিনে দেখানো হয়েছে।

আরও পড়ুন <-> রো‌হিঙ্গা সংকট সমাধা‌নে জা‌তিসংঘ‌কে ভূ‌মিকা রাখার আহ্বান মোমেনের

মিয়ানমারের মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ-এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গত মাসের মাঝামাঝিতে প্রায় সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাই ও সাক্ষাৎকার নিয়ে গেছেন। তারা সব মিলিয়ে ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।

টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল 

ওই প্রতিনিধিদল দেশে ফিরে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত নেইপিদো থেকে কোনো বার্তা আসেনি। তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর গত ২৭ মার্চ বৈঠক করেছিল সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিনিধিদল এখানে থাকা অবস্থায় ভেরিফিকেশনের বাইরে কোনো কথা বলেনি। দেশে ফিরে যাওয়ার পরও কোনো বার্তা মিয়ানমার থেকে আসেনি। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে, থাকবে।

এদিকে, চলতি মাসের ২৪ এপ্রিল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় মিয়ানমারের পাল্টা যুক্তি উপস্থাপনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে চীনের মধ্যস্থতার সঙ্গে বিষয়টির সম্পর্ককে উড়িয়ে দিচ্ছেন না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আইসিজেতে তারা এটা দেখাতে পারবে যে তারা এ বিষয়ে কাজ করছে, প্রতিনিধিদল কাজ করে গেছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল চার লাখের অধিক রোহিঙ্গা। এছাড়া প্রতি বছর নতুন করে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পগুলোতে।

এনআই/এমজে