‘আমার ছেলে অপরাধী বা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিল না। রায়হানের ওপর পুলিশের কোনো আক্রোশও নেই। কোনো কারণ ছাড়া পুলিশ তাকে কেন হত্যা করবে? আমার রায়হান কয়েকজনের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছে। অসৎ কাজে বাধা দেওয়াই আমার ছেলের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে’— হত্যাকাণ্ডের তিন মাস পার হলেও প্রকৃত রহস্য না জানতে পেরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঢাকা পোস্টের কাছে এসব অভিযোগ করেন নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম।

মামলার মূল আসামি এসআই আকবরসহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের তিন মাস পার হলেও তাকে কেন খুন করা হয়েছে তা জানতে পারলাম না। পুলিশ আমাদের এখন পর্যন্ত যেসব কারণ জানিয়েছে তা সন্তোষজনক নয়

নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম

 

গত ১১ অক্টোবর সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান নগরীর আখালিয়ার নেহারিপাড়ার যুবক রায়হান আহমেদ।

ছেলের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সালমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার মূল আসামি এসআই আকবরসহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের তিন মাস পার হলেও তাকে কেন খুন করা হয়েছে তা জানতে পারলাম না। পুলিশ আমাদের এখন পর্যন্ত যেসব কারণ জানিয়েছে তা সন্তোষজনক নয়।

তিনি অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে এসআই আকবর ও সাংবাদিক নোমান। রায়হানকে হত্যার পর আমরা জানতে পারি, আকবর ও নোমান আমাদের পাড়ার একটি বাসায় নিয়মিত আসতো। ওই বাসার দুইটি মেয়ের সঙ্গে আকবর ও নোমানের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। পাড়ায় অসামাজিক কাজ চলায় এসআই আকবরকে বাধা দেন রায়হান। তখন রায়হানকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় আকবর। আমার ধারণা আকবর ও নোমানের কু-কর্মে বাধা দেওয়ায় তারা রায়হানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

এসব তথ্য আমি পিবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছি। কিন্তু আমার মনে হয় না তারা এসব অভিযোগ গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা আমাকে শুধু বলছে অপেক্ষা করেন তদন্ত শেষ হলে সব জানতে পারবেন।

নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম

 

সালমা বেগম বলেন, এসব তথ্য আমি পিবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছি। কিন্তু আমার মনে হয় না তারা এসব অভিযোগ গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা আমাকে শুধু বলছে অপেক্ষা করেন তদন্ত শেষ হলে সব জানতে পারবেন।

এদিকে দীর্ঘ তিন মাস পার হলেও সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে মৃত্যু হওয়া রায়হান আহমেদের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য এখনও জানা যায়নি। হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত উদ্দেশ্য বের না হওয়ায় চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। যদিও মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই বলছে- নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করা হবে।

হত্যাকাণ্ডের শুরুতে ‘ছিনতাইকারী সন্দেহে রায়হান গণপিটুনিতে মারা গেছেন’ এই তথ্য ইতোমধ্যে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া ‘টাকার কারণে রায়হানকে পুলিশ হত্যা করেছে’ এই তথ্যের সত্যতা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রায়হানের পরিবার সূত্রে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের শুরুতে ‘ছিনতাইকারী সন্দেহে রায়হান গণপিটুনিতে মারা গেছেন’ এই তথ্য ইতোমধ্যে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া ‘টাকার কারণে রায়হানকে পুলিশ হত্যা করেছে’ এই তথ্যের সত্যতা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।

এ বিষয়ে রায়হানের পরিবার বলছে, টাকা চাওয়ার পর তারা পুলিশকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তাদের প্রশ্ন, তাহলে টাকার জন্য কেন রায়হানকে হত্যা করা হবে। এছাড়া ঘটনার দিন সিলেটের সাগরদীঘির পাড়ে জরুরি কাজের কথা বলে রায়হানকে কারা ফোন করে নিয়ে গিয়েছিল, সেই তথ্য এখনও অজানা।

এদিকে রায়হান হত্যা মামলার এজহারে তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী উল্লেখ করেন, কে বা কারা রায়হানকে ধরে নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে মারধর করার পাশাপাশি তার হাতের নখ তুলে ফেলে। এছাড়া ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে রায়হানের লাশ ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পান তিনি।

নির্যাতনের ধরন দেখে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে, এত অল্প পরিমাণ টাকার জন্য রায়হানকে হত্যা করা হয়নি। তারা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। কেউ এসআই আকবরকে টাকা দিয়ে অথবা আকবরের কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে রায়হানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর এ পরিকল্পনায় আকবরের সঙ্গে নোমান নামে স্থানীয় এক সাংবাদিক সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ করছে রায়হানের পরিবার।

গত ১৩ অক্টোবর রায়হান হত্যা মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। তদন্তভার পেয়েই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ধারে পিবিআই মাঠে নামে।

পিবিআই বলছে, মামলার রহস্য উদঘাটনের কাছাকাছি রয়েছে তারা। তাদের হাতে ইতোমধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এসেছে যা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত মোটিভ জানতে সাহায্য করবে।

পিবিআই বলছে, মামলার রহস্য উদঘাটনের কাছাকাছি রয়েছে তারা। তাদের হাতে ইতোমধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এসেছে যা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত মোটিভ জানতে সাহায্য করবে। তবে হত্যাকাণ্ডে পুলিশ ছাড়া বাইরের কোনো লোক জড়িত কিনা সে বিষয়ে কোনো তথ্য তাদের হাতে আসেনি। কিন্তু এ বিষয়টিও তারা গুরুত্ব সহকারে দেখছে।

পুলিশের তদন্তকারী সংস্থাটি আরও বলছে, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সিসি ক্যামেরার সঙ্গে যুক্ত কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ও সাংবাদিক নোমানকে তারা এখন খুঁজছেন। নোমান ও হার্ডডিস্ক পেয়ে গেলে তারা রায়হান হত্যার মূল রহস্য তদন্ত প্রতিবেদনে পরিষ্কার করতে পারবেন।

রায়হান হত্যাকাণ্ডের মোটিভ খুঁজে বের করতে আমরা চেষ্টা করছি। সাংবাদিক নোমান ও হার্ডডিস্কটি খুঁজে পেলে আমরা প্রকৃত সত্য জানতে পারব

ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার

 

মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, রায়হান হত্যাকাণ্ডের মোটিভ খুঁজে বের করতে আমরা চেষ্টা করছি। সাংবাদিক নোমান ও হার্ডডিস্কটি খুঁজে পেলে আমরা প্রকৃত সত্য জানতে পারব। যদিও আকবর আমাদের ইতোমধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তবে নোমান ও হার্ডডিস্কটি পেলে মামলার রহস্য সম্পূর্ণরূপে উদঘাটিত হবে। যাকে বলে চাক্ষুষ প্রমাণ।

হত্যাকাণ্ডে পুলিশ ছাড়া অন্য কেউ জড়িত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও বাইরের কোনো লোকের জড়িত থাকার বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি। তবে তদন্তে শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব

হত্যাকাণ্ডে পুলিশ ছাড়া অন্য কেউ জড়িত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও বাইরের কোনো লোকের জড়িত থাকার বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি। তবে তদন্তে শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।

অভিযুক্ত আকবরকে পালাতে সহায়তাকারীদের বিষয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, আসলে এটি হচ্ছে পুলিশের অভ্যন্তরীণ নিয়ম শৃঙ্খলার বিষয়। এই বিষয়টি আমরা দেখছি না। তবে এ বিষয়ে তদন্তে যেসব তথ্য এসেছে, সেগুলো আমরা পুলিশ সদর দফতরের আরেকটি তদন্ত কমিটিকে জানিয়ে দিয়েছি।

উল্লেখ্য, গত ১১ অক্টোবরে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হানকে নির্যাতন করে এসআই আকবর ও তার দলবল। পরে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয় বলে জানান চিকিৎসকরা।

পরদিন রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী সিলেট কোতোয়ালি থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পর রায়হান হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর, হাসান উদ্দিনসহ পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়।

পরে গত ৯ নভেম্বর দুপুরে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে মামলার প্রধান আসামি এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রায়হান হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত এসআই আকবরসহ চার পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস, হারুনুর রশিদকে দুই দফায় আট দিন করে ও এএসআই আশেক এলাহীকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া গত ১০ নভেম্বর এসআই আকবরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত।

অন্যদিকে রায়হানকে ছিনতাইকারী হিসেবে অভিযোগকারী শেখ সাইদুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই। পরে গত ১৫ নভেম্বর আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

 

এমএসি/টিএম