হজ নিবন্ধনে ভাটা
সৌদিতে বাড়ি ভাড়ার দিকে তাকিয়ে হজ এজেন্সিগুলো
• আট কারণে বেড়েছে হজ খরচ
• তিন দফা সময় বাড়িয়েও কোটা খালি ৩০ হাজার
• বেসরকারিতে খালি সাড়ে ২৪, সরকারিতে ৫৪৮৫
নির্ধারিত সময়ের পর তিন দফা সময় বাড়িয়েও নির্দিষ্ট কোটার হজযাত্রী পাচ্ছে না সরকার। শেষ পর্যন্ত চুক্তির কোটা পূরণ হয় কি না— তা নিয়ে সংশয়ে মন্ত্রণালয়। এদিকে শেষ মুহূর্তে সৌদিতে বাড়ি ভাড়া কমার দিকে তাকিয়ে আছে হজ এজেন্সিগুলো। এজন্য হাতে থাকা হাজিদের নিবন্ধন করাচ্ছে না তারা।
বিজ্ঞাপন
সৌদি আরবের সঙ্গে হজচুক্তি অনুযায়ী এবার বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। এর মধ্যে এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করার সুযোগ পাবেন। বেসরকারি হজযাত্রীদের নিবন্ধনের কাজটিও করে থাকে হজ এজেন্সিগুলো। হজে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরও হজযাত্রীদের নিবন্ধন করছে না কিছু এজেন্সি। তারা শেষ মুহূর্তে বাড়ি ভাড়ার রেট দেখে নিবন্ধন করবে বলে জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন : হজের খরচ কমাতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্যোগ নিতে বললেন হাইকোর্ট
চলতি বছর সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে জনপ্রতি হজের খরচ নির্ধারণ হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টাকা। এবারের খরচ দেড় লাখ বেশি হওয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। যা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ খরচকে অস্বাভাবিক, অমানবিক দাবি করে তা কমানোর দাবি জানিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় বলছে, হজের খরচ কমানোর আপাতত কোনও সুযোগ নেই। সৌদিতে বাড়ি ভাড়া কমা সাপেক্ষে তা কিছুটা কমতে পারে। যদি কমে সেই টাকা হজ আদায় শেষে ফেরত পাবেন। তবে কত কমবে সেটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না।
হজ অনুবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অন্যান্য বছর মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে প্রাক নিবন্ধনের কাজ হলেও এবার ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়। এটা করার কারণ আগে-ভাগে নিবন্ধনের কাজ শেষ করে বাড়ি ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করা। এদিকে হজযাত্রীদের প্রকৃত সংখ্যা সৌদি সরকারকে জানানোর শেষ তারিখ আগামী ৯ মে। হাতে এখনো ২৪ দিন সময় আছে। তাই হজ এজেন্সি ও ধর্ম মন্ত্রণালয় বাড়ি ভাড়ার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন। শেষের দিকে বাড়ি ভাড়া ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে এমন নজির আছে। যদি এমনটা হয় তবে এখাতে কিছু টাকা সাশ্রয় হবে। গত বছর সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ফেরত পেয়েছিল হাজিরা।
আরও পড়ুন : এবারের হজ প্যাকেজ অমানবিক : হাইকোর্ট
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হ্জ অনুবিভাগ) মতিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চারদিক থেকে হজের খরচ কমানোর দাবি আসছে। এবারের হজের খরচ বেশি হয়েছে এটা সত্য, কিন্তু আমাদের কী করার আছে। এবার হজের খরচ বেড়েছে সৌদিতে বাড়ি ভাড়া ও বিমান ভাড়ার কারণে। বিমান ভাড়া কমানোর জন্য সব চেষ্টা করেছি। তারা একটাকাও কমাবে না। এখন বাকি আছে সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া। সবচেয়ে কম রেটে বাড়ি ভাড়ার করার চেষ্টা করছি। যদি সম্ভব হয় তবে এখানে কিছু টাকা ফেরত পাবেন হাজিরা। তবে সেটাও হজ পালন শেষ করার পর।
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সিনিয়র সভাপতি ইয়াকুব শরাফতি ঢাকা পোস্টকে, এজেন্সিগুলো সৌদিতে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছে। শেষ মুহূর্তে বাড়ি ভাড়া কমবে এমন আশায় নিবন্ধন করতে চাওয়া হজযাত্রীদের বোঝানো হচ্ছে। তবে শেষ সময়ে কোটা পূরণ হয়ে যাবে বলে আশা করছি।
যে কারণে বেড়েছে হজের খরচ
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হ্জ অনুবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, হজ প্যাকেজ বাড়ার অন্যতম কারণ বিমান ও বাড়ি ভাড়া বাড়ানো। চলতি বছর এ দুটি খাতে খরচ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আবার বাড়ির ভাড়া পরিশোধ করতে হয় ডলারে। এই ডলারের দামও অস্বাভাবিক। সব মিলিয়ে এ দুটি খাতে খরচ কমানোর কোনও সুযোগ নেই। এখানে মন্ত্রণালয়ের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। বাড়ি ভাড়া সৌদি আরবের হাতে, আর বিমান ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদি এয়ারলাইন ও বাংলাদেশ বিমান।
গত বছর হজ প্যাকেজে বাড়ি ভাড়া (ভ্যাটসহ) ছিল ৬ হাজার ৫০৪ রিয়াল বা ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ২০১ রিয়াল বা ২ লাখ ৪ হাজার ৪৪৫ টাকা। এখাতে খরচ বেড়েছে ৪৭ হাজার। গত বছর বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি রিয়ালের দাম ২৪ দশমিক ৩ টাকা হিসাব করা হয়েছিল। চলতি বছর তা হিসাব করা হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৯ টাকা।
আরও পড়ুন>>হজের পাহাড়সম খরচ কমাতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি
চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া ও আসার বিমান ভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। গত বছর যাওয়া-আসার (রাউন্ড ট্রিপ) বিমানভাড়া ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এবার তা ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। অর্থাৎ এ দুটি খাতে গত বছরের এবার খরচ বেড়েছে ১ লাখ ৪ হাজার টাকা। হজে অন্যান্য মিনা, আরাফাহ ও মুজদালিফায় হজযাত্রীদের তাঁবুর ব্যবস্থা, তাঁবুতে ম্যাট্রেস, বিছানা, চাদর, বালিশ, কম্বল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও প্রতিদিনের খাবার সরবরাহ করতে হয়। এ খাতে গত বছর প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ৫২০ রিয়াল বা ৬১ হাজার ২৩৬ টাকা (প্রতি রিয়াল ২৪ দশমিক ৩ টাকা ধরে) নির্ধারণ করা হয়েছিল। চলতি বছর এ খাতের খরচ বেড়েছে। এছাড়া যাত্রীদের খাবার খরচ, জমজমের পানি, ভিসা ফি ও হজ গাইড বাবদ ব্যয়ও বেড়েছে।
এদিকে বুধবার হাইকোর্টে হজ প্যাকেজের দাম নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সেখানে ৮টি কারণ বলা হলেও মোটাদাগে বাংলাদেশের টাকা সঙ্গে সৌদি রিয়ালের বিনিময় হার বৃদ্ধি, বিমান ভাড়া বৃদ্ধি এবং মক্কা-মদিনা ব্যাপক সংখ্যক বাড়ি ভাঙার কারণে এবার বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে এবার হজের প্যাকেজ বৃদ্ধি পেয়েছে।
হাজিদের ওপর ভ্যাট-চার্জের বোঝা
গত কয়েক বছর হ্জযাত্রীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর-চার্জের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে সৌদি ও বাংলাদেশ সরকার। সরকারি ব্যবস্থাপনায় একজন হজযাত্রীর মোট ব্যয়ের ১৯ শতাংশ এবং বেসরকারি পর্যায়ে একজন হজযাত্রী মোট খরচের ২০ শতাংশ খরচ হয় দুই দেশের সরকারের বিভিন্ন কর-চার্জের কারণে।
আরও পড়ুন>>দেড় লাখ টাকা বাড়িয়ে বেসরকারি হজ প্যাকেজ ঘোষণা
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর সরকারিভাবে হজের প্যাকেজ ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা এবং বেসরকারিভাবে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসেবে সরকারিভাবে একজন হজযাত্রীকে কর-চার্জ বাবদ দিতে হয় ১ লাখ ২৭ হাজার। এর মধ্যে ৬২ হাজার টাকার বেশি বাংলাদেশের ভ্যাট ও বিভিন্ন চার্জ, বাকি প্রায় ৬৫ হাজার টাকা সৌদি আরবে ভ্যাট ও বিভিন্ন চার্জ। একইভাবে ২০ শতাংশ হারে বেসরকারি পর্যায়ে একজন হজযাত্রীকে ভ্যাট ও অন্যান্য চার্জে ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। এরমধ্যে বাংলাদেশে হাজার টাকা বাকি প্রায় ৬২ হাজার টাকা ব্যয় হবে সৌদিতে। এছাড়া প্রত্যেক হজযাত্রীর আইডিকার্ড ও ল্যাগেজ ট্যাগ, কল্যাণ তহবিল, প্রশিক্ষণ ফি, খাওয়া খরচ, হজ গাইড, মোনাজ্জেম, সার্ভিস বাবদ বাদে প্রায় ৬২ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
হজ এজেন্সির মালিকরা হজযাত্রীদের জন্য এ ভ্যাট-চার্জ মওকুফ করার দাবি জানিয়েছে। হজ প্যাকেজে দুই দেশ মোটা অঙ্কের ভ্যাট ও অন্যান্য চার্জ মওকুফ করলে হাজিদের কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হবে। এজন্য সৌদি সরকারের সঙ্গে আলোচনার দাবি জানান তারা।
১০ বছরে হজের ব্যয় বাড়ল কত
২০০৮ সালে হজের খরচ ছিল সর্বনিম্ন ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে আরও বেড়ে হয় ৩ লাখ ১৯ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ১৮ হাজার টাকা। গত মৌসুমে খরচ লেগেছে গড়ে ৫ লাখ ২১ টাকার বেশি। এর বাইরেও হজযাত্রীদের নানা খরচ আছে। একটু আয়েশিভাবে হজ করতে চাইলে খরচ আরও বেশি লাগবে। গত বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্যাকেজে-১ এ সর্বোচ্চ ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা লেগেছে। চলতি মৌসুমে এই খরচ বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। কোরবানি ও ব্যক্তিগত খরচ হিসাব করলে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা খরচ হবে।
তিন দফা সময় বাড়িয়ে হজের কোটা খালি ৩০ হাজার
হজচুক্তি অনুযায়ী, এবার বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এ নিবন্ধনের সময় তিন দফা বাড়ানো হয়েছে। তৃতীয় দফার মেয়াদ শেষ হবে ১৬ মার্চ (বৃহস্পতিবার)।
বুধবার (১৫ মার্চ) বিকেল ৫টা পর্যন্ত হজে যেতে চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন করেছেন মাত্র ৯৭ হাজার ২৩১ জন। এ হিসেবে এখন পর্যন্ত ২৯ হাজার ৯৬৭ জন হজযাত্রীর কোটা খালি রয়েছে। এরমধ্যে সরকারিতে এখনো খালি রয়েছে ৫ হাজার ৪৮৫ জন। আর বেসরকারিতে নিবন্ধনের বাকি রয়েছে ২৪ হাজার ৪৮২ জন।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজযাত্রী প্রাক-নিবন্ধন সিস্টেমের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে হজে যেতে ইচ্ছুক দুই লাখ ৪৯ হাজার ২২৪ জন প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন। এদের মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন আট হাজার ৩৯১ জন। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাক-নিবন্ধন করেছিলেন দুই লাখ ৪০ হাজার ৮৩৩ জন।
এনএম/এসএম