ঢাকা-মস্কো বৈঠক : রূপপুরের অর্থ লেনদেনে সুরাহা চাইবে উভয়পক্ষ
ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হয় রাশিয়াকে। আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে অর্থ লেনদেন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ও রাশিয়া। কিন্তু প্রায় বছরখানেক সময়েও অর্থ লেনদেন প্রক্রিয়ার সুরাহা করতে পারেনি ঢাকা-মস্কো।
বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতাবিষয়ক আন্তঃসরকারি কমিশনের চতুর্থ অধিবেশনে সোমবার (১৩ মার্চ) তিন দিনব্যাপী ভার্চুয়াল বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ-রাশিয়া। বৈঠকে মূল আলোচনার বিষয়ে থাকবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে অর্থ লেনদেন প্রসঙ্গ।
বিজ্ঞাপন
বৈঠকে ঢাকার পক্ষ থেকে ব্যাংকিং লেনদেন আরও সহজ, বিকল্প এবং নিরাপদ অর্থ লেনদেনে গুরুত্ব দেওয়া হবে। অন্যদিকে একই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়ে মস্কো বাংলাদেশি ব্যাংকের সঙ্গে রাশিয়ার ব্যাংকের আর্থিক সংযোগ নিয়ে আলোচনা করবে। এক্ষেত্রে উভয়পক্ষ অর্থ লেনদেন প্রক্রিয়ায় সুরাহায় পৌঁছাতে চাইবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ঢাকার পক্ষে বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, ইআরডি, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থাকবেন।
আলোচনার টেবিলে কোন বিষয়গুলো থাকছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, তিন দিনব্যাপী ভার্চুয়াল বৈঠক হবে। সামগ্রিক ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। এরমধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে অর্থ লেনদেন বিষয়টি মূল ফোকাসে থাকবে।
ঢাকা-মস্কোর কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রাশিয়ার পক্ষ থেকে দেশটির ৬৯টি জাহাজকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বৈঠকে আলোচনায় আনতে চেয়েছে মস্কো। কিন্তু ঢাকার পক্ষ থেকে এ বৈঠকে জাহাজের বিষয়টি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত না করার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ইআরডি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, রাশিয়া রূপপুরের জন্য ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে। রাশিয়ার ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুধু সুদ এবং এরপর থেকে সুদ ও আসল বছর বছর কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। ঋণের ৪৯৭ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে। বাকি ৬৪১ কোটি ডলার।
বছরে দুটি কিস্তিতে রাশিয়াকে রূপপুরের জন্য অর্থ দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। কিন্তু ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে লেনদেন ঝামেলার কারণে এখন অবধি কোনো অর্থ রাশিয়াকে দিতে পারেনি বাংলাদেশ।
রূপপুরের ঋণ পরিশোধ নিয়ে বাংলাদেশকে গত বছরের ২৩ জুন প্রথম চিঠি দেয় রাশিয়া। ওই চিঠিতে দুই দেশের মধ্যে হওয়া আন্তঃসরকার ঋণচুক্তির (আইজিসিএ) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দেয় দেশটি। এরপর ওই বছরের ১০ আগস্ট আরেকটি চিঠি দেয় রাশিয়া। এতে মার্কিন ডলার ও ইউরোতে লেনদেন নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রুবলে লেনদেনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এরমধ্যে বিষয়টি সুরাহার করতে বেশ কয়েকবার বৈঠকও করেছে ঢাকা-মস্কো। বৈঠকে মস্কোর পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল, চীনা মুদ্রা ইউয়ানে অর্থ লেনদেন করার। কিন্তু ইউয়ান থেকে রুবলে লেনদেন করতে গেলে দুবার ট্রানজেকশান ফিস দিতে হতো বাংলাদেশকে। সেজন্য মস্কোর প্রস্তাবে রাজি হয়নি ঢাকা।
রাশিয়ার জাহাজ উরসা মেজরকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে না ভিড়তে দেওয়ায় ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক খারাপ হয় ঢাকা-মস্কোর। এতেই আপত্তি বাধে রাশিয়ার। এবার রূপপুরের লেনদেন নিয়ে চটে বসে রাশিয়া। মস্কো চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে একটি নির্দিষ্ট তারিখ চূড়ান্ত করে বকেয়া পরিশোধ করতে বলে। অন্যথায় জরিমানা গোনার বিষয়ে ঢাকাকে হুমকি দেয়।
এমন শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে মস্কোকে চিঠি পাঠিয়ে বকয়ো পরিশোধ করতে চায় ঢাকা। এক্ষেত্রে ঢাকা মস্কোর কাছে জানতে চায়, তারা কীভাবে টাকাটা নিতে চায়। ঢাকার চিঠির জবাবে সম্প্রতি মস্কো জানায়, বাংলাদেশকে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে অর্থ লেনদেন করলেই চলবে, রুবলে ট্রান্সফার করতে হবে না।
জানা গেছে, আন্তঃসরকারি কমিশনের চতুর্থ অধিবেশনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে অর্থ লেনদেন ছাড়াও ঢাকার পক্ষ থেকে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে-রাশিয়ায় বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশাধিকার, পারস্পরিক বাণিজ্য সুবিধা এবং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের মধ্যে সহযোগিতা, চেম্বার অব কমার্স এবং ট্রেড বডিগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদের বিনিময়, যৌথ মেলার আয়োজন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন ও সমঝোতা স্মারক সই, দুই দেশের ফেডারেশনের মধ্যে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি সই, শুল্ক সংক্রান্ত সহেযাগিতা, বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে এফটিএ/পিটিএ স্বাক্ষরের রাশিয়ার সমর্থন চাওয়া হবে।
শিল্পের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিষয়ে-বাংলাদেশে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) হাই-টেক পার্ক এবং অন্যান্য সম্ভাব্য খাতে রাশিয়ান এফডিআই, কেমিক্যাল প্ল্যান্ট স্থাপনে যৌথ উদ্যোগ; সার কারখানা, এলএনজি/এলপিজি এবং ফুয়েল/রিফাইনারি প্ল্যান্ট, পর্যটন, স্বাস্থ্যসেবা ও ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে আলোচনা করতে চায় ঢাকা।
এছাড়া রূপপুর এনপিপির সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী বাস্তবায়ন, সামুদ্রিক মাছ ধরার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, উপকূলীয় এবং উপকূলীয় এলাকায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে সহযোগিতা, কয়লা অনুসন্ধানে প্রযুক্তি, মহাকাশ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণে সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক রোমিং শুল্ক কমানোর বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই, সাইবার নিরাপত্তা সহযোগিতা, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে সহযোগিতা, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) এবং ফেডারেল এজেন্সি অন টেকনিক্যাল রেগুলেটিং অ্যান্ড মেট্রোলজির (জিওএসটি আর) মধ্যে সহযোগিতা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার, বাংলাদেশ এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে সব বিভাগীয় সদর দপ্তরের আইকন (নিউক্লিয়ার এনার্জি সম্পর্কিত তথ্য কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা এবং মহাকাশ গবেষণা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে রাশিয়াকে পাশে চাইবে ঢাকা।
অন্যদিকে মস্কোর পক্ষ থেকে আলোচনার টেবিলে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, দুই দেশের চেম্বার অব কমার্সের মধ্যে সহযোগিতা, ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিনিময়, যৌথ বাণিজ্যবিষয়ক প্রদর্শনী এফটিএ/পিটিএ-তে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে সমর্থন ও সহযোগিতা, তেল ও গ্যাস অন্বেষণে একসঙ্গে কাজ করার মতো বিষয়গুলো তোলা হবে।
এনআই/এসএম