যানজট, জলাবদ্ধতা, গ্যাস ও পানির অভাবসহ নানা সংকটে জর্জরিত ঢাকা শহর। এসব সমস্যা ও সংকট ছাপিয়ে বছরজুড়ে আলোচনায় থাকে মশার উপদ্রব। ক্ষুদ্র এ প্রাণীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসীকে বাঁচাতে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। কেবল বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছা যায়।      

অভিজাত এলাকা থেকে নিয়ে বস্তি এলাকা- রাজধানীর এমন কোনো স্থান পাওয়া যাবে না যেখানে মশার উপদ্রব নেই। কিছুদিন আগে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার উপদ্রব থাকলেও বর্তমানে বেড়েছে কিউলেক্স মশা। মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগকে ‘লোক দেখানো’ বলে সমালোচনা করছেন ঢাকার নাগরিকেরা।  

রাজধানীর মিরপুর শেওড়াপাড়ার একটি বাসার নিচ তলায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে এক বেসরকারি চাকিরিজীবী। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, দিন নেই রাত নেই সব জায়গায় শুধু মশা। দিনেও বাসায় মশারি টাঙিয়ে রাখতে হচ্ছে। বাসায় দুই মাস বয়সী একটি বাচ্চা আছে আমার। এ বাচ্চার জন্য বাসায় অ্যারোসল দেওয়া যায় না, কয়েল জ্বালানো যায় না।
তিনি বলেন, সামান্য মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সিটি করপোরেশন, তাহলে তারা আমাদের অন্য সেবাগুলো কীভাবে দেবে? 

শুধু মিরপুর নয় রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় বেড়েছে মশার উপদ্রব। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজধানীর সায়দাবাদ এলাকার একটি বাসার মালিক আলহাজ মকিদুর রহমান বলেন, মশার সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। বাইরের দোকান, রাস্তাঘাট এমনকি বাসেও মশা লাগছে। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। বাড়িতে রাতে না হয় মশারি টাঙিয়ে ঘুমালাম কিন্তু অন্য সময় মশার অত্যাচারের সমাধান করব কীভাবে? 

জ্যেষ্ঠ এ নাগরিক বলেন, রাজধানীতে মশার নিয়ন্ত্রণ করা তো দুই সিটি করপোরেশনের কাজ, কিন্তু তারা করছেটা কী? এখন কোথাও তাদের কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছি না।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন অবশ্য বলছে, মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের অভিযান, জরিমানা, মনিটরিং, সচেতনতা সৃষ্টির কাজ অব্যাহত আছে। 
মশা নিধনে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে কেবল কীটনাশকের জন্য ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ২২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এছাড়া এবার মশক নিধনে ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সেখানে মশার ওষুধ-বাবদ ৪০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কচুরিপানা, আগাছা পরিষ্কার ও পরিচর্যায় এক কোটি ৫০ লাখ টাকা, ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন পরিবহনে চার কোটি টাকা, আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ২৫ কোটি টাকা এবং মশক নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযানে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখ হয়েছে। সবমিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশা মারতে ৭৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এত টাকা বরাদ্দ করেও নগরবাসীকে মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারছে না দুই সিটি করপোরেশন।

নানা সময়ে নানা পদক্ষেপ, ফলাফল শূন্য

মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সময় খাল, ড্রেন ও জলাশয়ে গাপ্পি মাছ, তেলাপিয়া মাছ ও হাঁস ছেড়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই দমাতে পারছে না মশা। 

২০২১ সালে মশার লার্ভা খেয়ে ফেলার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১০টি জলাশয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যাঙ ছাড়া হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল এ ব্যাঙ বংশবিস্তার করবে এবং জলাশয় থেকে লার্ভা খেয়ে মশার বংশবিস্তার রোধ করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এতে খুব একটা কাজ হয়নি।

সবশেষ গত বছর মশার ওষুধ ছিটানোর সঙ্গে সঙ্গে জিঙ্গেল (সচেতনমূলক গান) বাজিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ অঞ্চলের প্রতি এলাকায় দুজন করে মশক নিধনকর্মী ওষুধ ছিটিয়ে যান। তাদের পাশাপাশি আরেকজন হ্যান্ড মাইকে জিঙ্গেল বাজান। সেখানে মূলত সচেতনতামূলক গান বাজতে থাকে। মশক নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর করণীয় এবং তাদের সচেতনতার বার্তা প্রচার করা হয়। এতে কী ফল এসেছে তাও প্রশ্নবিদ্ধ।

এদিকে গত বছরের জুলাই থেকে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তরের অধীন প্রতিটি বাসাবাড়িতে অত্যাধুনিক ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎস খুঁজতে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হয়। সিটি করপোরেশন ড্রোন থেকে ছবি ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যেসব বাড়িতে মশার লার্ভা পাওয়া যায় তার একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করে এবং বছরের অন্যান্য সময় মশক নিধন কার্যক্রমে এটি কাজে লাগায়।

সে সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ডিএনসিসির আওতাধীন এলাকায় এডিস মশার উৎস খুঁজতে ড্রোনের মাধ্যমে ১ লাখ ২৮হাজার বাড়ির ছাদ পরিদর্শন করা হয়েছে। এছাড়া ছাদ বাগানগুলো মনিটরিং করা হয়েছে ড্রোনের মাধ্যমে। ফলে তাদের কাছে একটি ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে।

২০২১ সালে ড্রোন দিয়ে ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারার উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। রাজধানীর বনানী লেকে একটি ড্রোন ব্যবহার করে মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য পরীক্ষামূলকভাবে কার্যক্রম চালিয়েছিল ডিএনসিসি। প্রতি মিনিটে ড্রোন ছিটাতে পারত ৫ লিটার মশার ওষুধ। প্রাথমিকভাবে এটি ২০ লিটার ওষুধ বহন করতে সক্ষম। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সফল হলে ডিএনসিসির জলাশয়, খাল বা লেকে মশা মারতে ব্যবহার করতে চেয়েছিল এমন ড্রোন। যদিও শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটি সফল হয়নি। 

বিভিন্ন সময় এমন নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেও রাজধানীবাসীকে মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে পারছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

কী বলছে দুই সিটির কর্তৃপক্ষ

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার পর রাজধানীতে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় ৮০০ কিলোমিটার নর্দমা ও বক্স কালভার্ট রয়েছে। এসব স্থানে সঠিকভাবে মশার ওষুধ স্প্রে করা যাচ্ছে না। এছাড়া দুই বাসার মাঝখানের স্থানগুলোতে ওষুধ প্রয়োগে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ফলে অর্থ খরচ করেও তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। মার্চ মাসজুড়ে মশার উপদ্রব বাড়তে পারে, তবে সামনের মাসের প্রথম দিকে কিউলেক্স মশার উপদ্রব কমে আসবে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক বলেন, সিটি করপোরেশনের এলাকা অনেক বড়, সব এলাকায় মশক নিধনের কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। শুধু সিটি কর্পোরেশন নয়, সবাইকেই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। আমাদের সকল ওয়ার্ডে মশক নিধনকর্মীরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাছির বলেন, মশা বেড়েছে সত্য। আমরা আমাদের জনবল দিয়ে নিয়মিত মশা মারার ওষুধ ছিটানোর কাজ করে যাচ্ছি। যেসব স্থানে মশা জন্মায় সেসব স্থানে আগে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। 

সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মশক নিধনে আমরা আমাদের জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছি। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসম্পৃক্ততা। আমরা আমাদের জায়গা থেকে শুধু কাজ করে গেলে হবে না, এ জন্য সবাইকে সচেতন হয়ে নিজ আঙ্গিনাসহ নিজেদের আওতাধীন জায়গায় মশার বংশবিস্তার যেন না হয় সেজন্য উদ্যোগ নিতে হবে।  

মেয়র আতিকের ভাবনা

মশক নিধন কার্যক্রম সম্পর্কে সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, মশক নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতার আলোকে কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আমরা দেখে এসেছি তারা কীভাবে মশা নিধনে কার্যক্রম পরিচালনা করে। আমরা বছরের ৩৬৫ দিনই সব এলাকায় একই ওষুধ একই মাত্রায় ছিটাই। কিন্তু মিয়ামিতে আগে মশার প্রজাতি নির্ণয় করা হয়। তারপর ওষুধ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। তাই আমাদের কাজ হবে ল্যাবে মশার প্রজাতি নির্ণয় করে এবং আচরণ গবেষণা করে ওষুধ প্রয়োগ করা।

বছরব্যাপী পদক্ষেপ দরকার : বিশেষজ্ঞ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, শুধু অভিযান পরিচালনা করে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা আলাদা টিম গঠন করে গুরুত্ব সহকারে কাজ করে যেতে হবে। এগুলোকে আবার মনিটরিংয়ের আওতায় রাখতে হবে। বছরব্যাপী কাজ করলে ধীরে ধীরে মশার উপদ্রব কমিয়ে আনা সম্ভব।

এএসএস/এসকেডি