সীতাকুণ্ডের অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনার পর কারখানার নানা অনিয়মের চিত্র উঠে আসছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা এসবের সত্যতাও পাচ্ছেন। এছাড়া মালিকপক্ষের বক্তব্যেও উঠে এসেছে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিষয়। তারপরও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্টদের। একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলেও যেন টনক নড়ছে না কারও। সর্বশেষ বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত এক ব্যক্তির স্ত্রী বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। যদিও সেই মামলা গ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন ত্রুটির কথা জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

তারা বলছেন, মামলায় যে সব ধারা উল্লেখ করা হয়েছে সবগুলো জামিনযোগ্য। আবার যে ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা করেছেন, তিনি কারখানার ত্রুটির কথা জানলেন কীভাবে? এজাহারে দেওয়া বক্তব্যের সূত্র কী? তিনি যে সব অনিয়মের বিষয় উল্লেখ করেছেন এগুলো জানার কথা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের। বাদী হয়ে তাদেরই মামলা দায়ের করা উচিত ছিল। এছাড়া এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে দণ্ডবিধি ছাড়াও বিশেষ আইনে মামলা করা যেত। এসব আইনে মামলা হলে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যেত।

আইনজীবীরা আরও বলছেন, কারখানার মালিকরা যথেষ্ট প্রভাবশালী। এক্ষেত্রে সাধারণ কেউ বাদী হলে তারা ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। অনেক সময় সমঝোতা করতে চাপও প্রয়োগ করেন। কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়েও যায়। এরপর বাদী মামলা পরিচালনা করতে আর সহায়তা করেন না। আদালতে যথাযথ সাক্ষী দেন না। এতে আসামিরা খালাস পেয়ে যান। এ ধরনের ঘটনা আদালতে অহরহ ঘটছে।

আরও পড়ুন : অতিরিক্ত চাপে বিস্ফোরণ, ধারণা কারখানা কর্মকর্তার

চট্টগ্রাম জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বারবার দুর্ঘটনা হচ্ছে এবং মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। এক্ষেত্রে জামিনযোগ্য ও সহজ ধারায় মামলা নেওয়া হচ্ছে। এটা তো মানা যায় না। সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ঘটনায় এক নারী বাদী হয়ে মামলা করেছেন দেখলাম। তিনি সেখানে কারখানার অনিয়মের কথা লিখেছেন। এসব কথা তিনি কীভাবে জেনেছেন এবং কী উদ্দেশ্যে লিখেছেন— তাও বোধগম্য নয়। এসব কথা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জানার কথা ছিল। এক্ষেত্রে প্রত্যেক দপ্তরের একজন বাদী হয়ে আলাদা আলাদা মামলা করা দরকার ছিল। এগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ আইন রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম দিদার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যে অনিয়মের কথা আসছে, এসব অনিয়মের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের বাদী হয়ে বিশেষ বিশেষ আইনে মামলা করা দরকার ছিল। নিহত ও আহতদের বিষয়ে সবার পক্ষ থেকে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করলে ভালো হতো। কারণ, সাধারণ কেউ বাদী হলে কারখানার মালিকরা আপসের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফল হন। আসামিরা খালাস পেয়ে যান।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক এস এম সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ওই প্ল্যান্টে শুধু অক্সিজেন উৎপাদনের অনুমতি ছিল। কিন্তু তাদের কারখানায় আমরা কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার পেয়েছি। এসবের কোনো অনুমতি ছিল না। তারা অদক্ষ লোক দিয়ে কারখানা চালাতেন বলে প্রাথমিক তদন্তেও উঠে এসেছে।’

আরও পড়ুন : বিএম ডিপোর মামলায় ‘গতি নেই’, এর মধ্যেই পাশের কারখানায় বিস্ফোরণ

এর পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসন তদন্ত কমিটি করেছে। সেখানে আমাদের দপ্তরের প্রতিনিধিও আছে। এখনও তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষে কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কারখানার মালিকরা যথেষ্ট প্রভাবশালী। এক্ষেত্রে সাধারণ কেউ বাদী হলে তারা ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। অনেক সময় সমঝোতা করতে চাপও প্রয়োগ করেন। কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়েও যায়। এরপর বাদী মামলা পরিচালনা করতে আর সহায়তা করেন না। আদালতে যথাযথ সাক্ষী দেন না। এতে আসামিরা খালাস পেয়ে যান। এ ধরনের ঘটনা আদালতে অহরহ ঘটছে

এর আগে সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে 'চট্টগ্রাম জেলার ভারী ও মাঝারি শিল্পপ্রবণ এলাকায় দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন’ শীর্ষক জরুরি সভার আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত ওই সভায় সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের নানা অনিয়মের বিষয় উঠে আসে। এদিন সভায় উপস্থিত হয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের এমডি মো. মামুন উদ্দিন।

তিনি জানান, ১৯৯৬ সালে তার বাবা আহমদ শফী কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে যাবতীয় নিয়মকানুন মেনে এটি পরিচালনা করা হয়। এখানে শিল্পকারখানায় ব্যবহারের অক্সিজেন প্রস্তুত করা হয়। দুর্ঘটনার সময় শ্রমিক-কর্মকর্তা মিলে ১৯ জন কর্মরত ছিলেন। তবে, এর পাশাপাশি অনেক পথচারীও আহত হন।

জেলা প্রশাসকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারখানার অপারেটররা ডিপ্লোমা-হোল্ডার। উনাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। ২৭ বছর ধরে তারা কারখানাটি চালাচ্ছেন। শনিবারের এটা দুর্ঘটনা। এতে কারও হাত নেই। কেন হয়েছে জানি না। আল্লাহ ভালো জানেন।

যদিও সভায় শুধু ইঞ্জিনিয়ার বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে কারখানা পরিচালনার বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান। তিনি বলেন, কারখানায় অ্যাসেম্বলিং পয়েন্ট ও সেফটি প্ল্যান্ট কিছুই ছিল না। অপরিকল্পিত ও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালিত হচ্ছিল।

আরও পড়ুন : জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মামলা

এদিকে, বিস্ফোরণের ঘটনায় সোমবার রাতেই সীতাকুণ্ড থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। বিস্ফোরণে প্রাণ হারানো আব্দুল কাদের মিয়ার স্ত্রী রোকেয়া বেগম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। এতে আসামি করা সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের এমডি মো. মামুন উদ্দিন (৫৫), পরিচালক পারভেজ হোসেন (৪৮) ও আশরাফ উদ্দিন বাপ্পি (৪২), ম্যানেজার আব্দুল আলীম (৪৫), প্ল্যান্ট অপারেটর ইনচার্জ সামসুজ্জামান শিকদার (৬২), প্ল্যান্ট অপারেটর খুরশিদ আলম (৫০), সেলিম জাহান (৫৮), নির্বাহী পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন, অ্যাডমিন অফিসার গোলাম কিবরিয়া, অফিসার শান্তনু রায়, সামিউল, সুপারভাইজার ইদ্রিস আলী, সানা উল্লাহ, সিরাজ উদ-দৌলা, রাকিবুল ও রাজীবকে।

মামলার এজাহারে বাদী রোকেয়া বেগম উল্লেখ করেন, তার স্বামী ১০-১৫ দিন আগে ফোনে একবার বলেছিলেন, কারখানায় অর্থের অভাবে অভিজ্ঞ, দক্ষ কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়েছে। বর্তমানে যারা কাজ করছেন তারা অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ। আল্লাহই জানেন, কখন কী দুর্ঘটনা ঘটে যায়।' একথা শুনে তারা খুব চিন্তিত ছিলেন। এর মধ্যে ৪ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাত কারণে কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পরে খবর পেয়ে বাদী তার স্বামীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখতে পান। সেখানে তার স্বামী কিছুক্ষণ চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান।

এজাহারে তিনি আরও উল্লেখ করেন, কারখানার মালিক ও আসামি হওয়া কর্মকর্তারা যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তারা বিপজ্জনকভাবে গ্যাস উৎপাদন, ভর্তি ও সরবরাহ করতেন। তারা তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার মতো প্রশিক্ষিত জনবল রাখেননি। এতে বিস্ফোরণে তার স্বামীসহ সাতজন মারা যান। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক), ৩৩৭, ৩৩৮ ও ৪২৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

এর মধ্য সর্বোচ্চ দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অবহেলাপূর্ণ কাজ করে অন্য কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়, তা যদি শাস্তিযোগ্য নরহত্যা না হয়, তবে তিনি পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার দুপুরে তদন্ত কর্মকর্তা ও সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু সাঈদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ সকালে মামলা বুঝে পেয়েছি। আমি তদন্ত কার্যক্রমে বের হয়েছি। আসামিদের কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন : অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ : ৩ মালিকসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা

মামলার এজাহারে বাদী রোকেয়া বেগম উল্লেখ করেন, তার স্বামী ১০-১৫ দিন আগে ফোনে একবার বলেছিলেন, কারখানায় অর্থের অভাবে অভিজ্ঞ, দক্ষ কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়েছে। বর্তমানে যারা কাজ করছেন তারা অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ। আল্লাহই জানেন, কখন কী দুর্ঘটনা ঘটে যায়।' একথা শুনে তারা খুব চিন্তিত ছিলেন। এর মধ্যে ৪ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাত কারণে কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পরে খবর পেয়ে বাদী তার স্বামীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখতে পান। সেখানে তার স্বামী কিছুক্ষণ চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান

জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কদমরসুল কেশবপুর এলাকার প্রায় এক একর জায়গায় সীমা অক্সিজেন লিমিটেড নামের কারখানাটি অবস্থিত। শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কারখানাটিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত সাতজন নিহত এবং ৩৩ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

নিহতরা হলেন- লক্ষ্মীপুর কমলনগর এলাকার মহিজল হকের ছেলে সালাউদ্দিন (৩৩), নেত্রকোণার কলমাকান্দা এলাকার খিতিশ রংদীর ছেলে রতন নকরেক (৫০), নোয়াখালীর সুধারাম এলাকার মৃত মকবুল আহমদের ছেলে আব্দুল কাদের মিয়া (৫৮), সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার মৃত বিম রুগার ছেলে সেলিম রিছিল (৩৯), একই এলাকার মৃত ইসমাইলের ছেলে শামসুল আলম (৬৫), সীতাকুণ্ডের জাফরাবাদ এলাকার মৃত আবুল বশরের ছেলে মো. ফরিদ (৩২) ও সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার মৃত মতি লাল শর্মার ছেলে প্রবেশ লাল শর্মা (৫৫)।

ওই ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এতে আহ্বায়ক করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসানকে। কমিটিতে সদস্য করা হয়েছে পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি), সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিনিধি এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রতিনিধিকে।

এমআর/এমএআর/এসএসএইচ