ধানমন্ডি থেকে বারিধারা পর্যন্ত চলবে ওয়াটার বাস
প্রতিদিন যানজটে আটকা পড়ে নাকাল অবস্থা রাজধানীবাসীর। যানজটের কারণে কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও। ২০১৭ সালে বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকার। চার বছরের ব্যবধানে এর পরিমাণ আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় যানজট থেকে মুক্তি দিতে ধানমন্ডি লেক থেকে নতুন নৌপথ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
এ পরিকল্পনায় ধানমন্ডি লেক থেকে পান্থপথের বিদ্যমান রাস্তায় দখল হওয়া খাল পুনরুদ্ধার করে নৌপথ যুক্ত হবে হাতিরঝিলের সঙ্গে। হাতিরঝিল থেকে গুলশান হয়ে বারিধারা পর্যন্ত বর্ধিত হবে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নৌপথ। প্রকল্পটির অর্থায়ন করবে রাজউক।
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ভালো নেই ঢাকার বাসিন্দারা। রাস্তায় বের হলে যানজটের অতিরিক্ত ভয় গ্রাস করে ঢাকাবাসীকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ধানমন্ডি থেকে বারিধারায় যাতায়াতের চিত্রই বদলে যাবে। প্রতিদিনের যানজট ঠেলে গন্তব্যে যেতে হবে না যাত্রীদের। এতে করে সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি ভোগান্তিও কমে যাবে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নৌপথ ব্যবস্থার প্রস্তাবনা সম্প্রতি বোর্ড সভায় উত্তোলন করা হয়েছে। সভায় বলা হয়, ঢাকা মহানগরীকে বসবাসযোগ্য করে তুলতে জলাধারগুলো রক্ষার বিকল্প নেই। অথচ ক্রমান্বয়ে অবৈধ দখলের কারণে শহরের খাল, পুকুর, বন্যাপ্রবাহ এলাকাগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ দখল বন্ধে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে জলাধারগুলো পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়াটাও জরুরি।
রাজধানীর গুলশান সংলগ্ন গুদারাঘাটে ওয়াটার ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিলেন আবির ফেরদৌস নামে এক চাকরিজীবী। তিনি বলেন, আমার বাসা ভাটারার দিকে আর অফিস কলাবাগান। প্রতিদিন আমি বাসা থেকে এফডিসি ঘাট পর্যন্ত যাই ওয়াটার ট্যাক্সিযোগে। সেখানে যেতে মাত্র ১৫-২০ মিনিট লাগে। এরপর বাকি পথ হেঁটে রিকশায় অফিসে যাই। আমার মতো হাজারো মানুষ হাতিরঝিলের এ নৌপথটি প্রতিদিন ব্যবহার করে। ধানমন্ডি থেকে হাতিরঝিল হয়ে গুলশান, বারিধারা পর্যন্ত ওয়াটার ট্যাক্সি চালু হলে দীর্ঘদিনের ভোগান্তি কমে যাবে।
এফডিসি ঘাটে কথা হয় সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এমন নৌপথ তৈরি হলে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট সময় লাগবে। এখন যদি বাস বা অন্য কোনো যানবাহনের মাধ্যমে যাই তাহলে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় লাগবে। এ নৌপথ বাস্তবায়ন হলে অনেকেই প্রাইভেট কার ব্যবহার বন্ধ করে দেবে।
এ বিষয়ে রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পান্থপথ খাল উদ্ধারের পর ধানমন্ডি থেকে হাতিরঝিল হয়ে গুলশান-বারিধারা পর্যন্ত নৌপথ এবং এর সার্বিক বিষয় নিয়ে বুয়েটের সঙ্গে আমাদের একটি সভা হয়েছে। তারা আমাদের শিগগিরই সার্বিক বিষয়ে ফিডব্যাক জানাবে। এরপর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।
পান্থপথ খাল পুনরুদ্ধার বিষয়ে তিনি বলেন, সেখানে ইতিমধ্যে অনেক কাজ এগিয়ে গেছে। চ্যানেলটা চালু হলে ট্রাফিক ইমপ্যাক্টটা কেমন হবে, মানুষ বের হবে কোন দিক থেকে, কোন দিকে চ্যানেলাইজড হবে সেটাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। এসব জায়গা যদি সমাধান করা যায়, তাহলে আমরা ধানমন্ডি লেকের সঙ্গে হাতিরঝিলের অংশ সংযুক্ত করতে পারব।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কতদিন সময় লাগবে এমন প্রশ্নের জবাবে ড্যাপ পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, অনেক বড় কর্মযজ্ঞ এটি। এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তবুও সবকিছু ঠিক থাকলে এটি বাস্তবায়ন হতে কমপক্ষে ৫ বছর সময় লেগে যেতে পারে।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত সংশোধিত ড্যাপে ঢাকাসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার দুই হাজার ১৯৮ কিলোমিটার জলাধার সিএস রেকর্ড অনুযায়ী উদ্ধার করে সচল করার সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে এসব এলাকাকে বিনোদন স্পটে পরিণত করারও সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ঢাকার চারপাশের ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ সচল করা এবং ১ হাজার ২৩৩ কিলোমিটার সড়ককে হাঁটার উপযোগী করার কথা বলা হয়েছে। শহরের বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে স্কুলভিত্তিক উন্নয়নেরও সুপারিশ করা হয়েছে।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষে পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে দিনে অন্তত ২১ লাখ পরিবহন ট্রিপের প্রয়োজন। কিন্তু যানজটের কারণে তিনভাগের একভাগ ট্রিপও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে প্রতি ৩ হাজার যাত্রী যাতায়াতের জন্য বাস ও মিনিবাস আছে মাত্র ১টি। আবার গণপরিবহন সংকটের কারণে প্রতিদিন বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও।
যদিও ভিন্ন কথা বলছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আদিল মুহম্মদ খান। তিনি বলেন, শুধু পান্থপথ খাল উদ্ধার করে এ নৌপথ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হলে তা কার্যকর হবে না। এ মুহূর্তে এই ধরনের প্রকল্প ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। অন্যান্য যেসব খাল পুনরুদ্ধার করা এখনও সম্ভব, সেগুলো আগে বাস্তবায়ন করা উচিত। ধানমন্ডি থেকে পান্থপথ হয়ে অনেক বড় বড় স্থাপনা হয়ে গেছে। সেগুলো যদি আমরা অপসারণ করতে চাই তাহলে আর্থিক ব্যয় বাড়বে। তাই এরকম ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলো এখনই না নেওয়া উচিত।
এএসএস/এসকেডি/এমএইচএস/এমএমজে