চট্টগ্রাম কাস্টমসে অপারেশনাল ম্যানেজারের কক্ষে দুই যুবকের অনুপ্রবেশ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পার হলেও কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে, আগে থেকেই কোনো পরিকল্পনা নিয়ে কারো যোগসাজশে অনুপ্রবেশ করে ওই দুই যুবক।  

জানা যায়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কাস্টমসের স্পর্শকাতর সফটওয়্যার কক্ষ থেকে দুই যুবককে হাতেনাতে আটক করেন আনসার সদস্যরা। এরপর তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে দুই দিনের রিমান্ডে এনেও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য বের করতে পারেনি পুলিশ। এজন্য পুনরায় রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। আদালতে সেটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

এছাড়া এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তারাও উদঘাটন করতে পারেনি ঘটনার রহস্য। কক্ষ থেকে কোনো কিছু চুরি হয়েছে কি না সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি তারা। গুরুত্বপূর্ণ এ কক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো কাস্টমস কর্মকর্তার যোগসাজশ আছে কি না সেটিও জানা যায়নি।

এদিকে দুই যুবকের অনুপ্রবেশের দিনটিও ছিল সাপ্তাহিক বন্ধের দিন শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি)। এছাড়া তাদের অনুপ্রবেশের সময় খুব সকাল হওয়ায় লোকজনের আনাগোনাও কম ছিল।

গ্রেপ্তার হওয়া দুই যুবক হলেন- মো. মেহেদী হাসান ওরফে রায়হান (২৯) ও খায়েজ আহমেদ (২৯)। তাদের মধ্যে মেহেদীর বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়া খেপুপাড়া এলাকায়। তার বাবার নাম আলী আহমেদ। খায়েজের গ্রামের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার নৈরাজপুর জামাল মেম্বার বাড়িতে। তার বাবার নাম জামাল উদ্দিন। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের সবচেয়ে বড় শুল্ক-কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এখান থেকে প্রতিবছর কম-বেশি ৬০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে সরকার। এই প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন গড়ে সাত হাজার বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয়ে থাকে। এসব বিল অব এন্ট্রি শুল্কায়ন সংক্রান্ত অ্যাসাকুইডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের কার্যক্রম অপারেশনাল ম্যানেজারের কক্ষে হয়ে থাকে। এজন্য কক্ষটি খুবই স্পর্শকাতর।

পুলিশ বলছে, চট্টগ্রাম কাস্টমসে দুই যুবকের অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে অবশ্যই কারো যোগসাজশ রয়েছে। এছাড়া অভিযুক্ত দুই যুবক একসময় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের অফিসে চাকরি করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আগে থেকে চুরির কয়েকটি মামলাও রয়েছে। 

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের যোগসাজশে অভিযুক্তরা কাস্টমস হাউসের গুরুত্বপূর্ণ কক্ষে অনুপ্রবেশ করেছেন কি না?

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েকটি প্রশ্ন সামনে রেখে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। অভিযুক্ত দুই যুবক কোন উদ্দেশে কাস্টমস হাউসে ঢুকেছে? তারা সেখানে কিছু চুরির চেষ্টা করছিল, নাকি কোনো সফটওয়্যার আনলক করার চেষ্টা করছিল? অভিযুক্তদের পেছনে কারা জড়িত?

পুলিশ সূত্র জানায়, আসামি মেহেদী ও খায়েজের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরের বন্দর থানায় দুটি চুরি মামলা রয়েছে। এছাড়া মেহেদীর বিরুদ্ধে খুলশী থানায় চোরাই মালামাল বেচাকেনার অভিযোগে একটি এবং হালিশহর থানায় একটি মাদকের মামলা রয়েছে। আসামি খায়েজের বিরুদ্ধে খুলশী থানায় একটি মাদকের মামলা রয়েছে।

সেদিনের ঘটনার বিষয়ে কাস্টমস সূত্র জানায়, দুই যুবকের মধ্যে একজন কাস্টমস হাউসের নিচতলায় আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত সফটওয়্যার কার্যক্রমের দায়িত্বপ্রাপ্ত অপারেশনাল ম্যানেজারের কক্ষে ঢুকে পড়েন। এ কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হলেন ডেপুটি কমিশনার নুরুন নাহার লিলি। অভিযুক্তদের অন্যজন কক্ষের বাইরে থেকে পাহারা দেন। পরে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের সহায়তায় দুই যুবককে আটক করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।

আটকের পর অভিযুক্তরা জানান, তারা ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে করে চট্টগ্রাম এসে কাস্টমস হাউসে ঢুকেছেন। তবে কী কারণে কাস্টমস হাউসে এসেছেন তার সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেননি অভিযুক্তরা।

এ সময় অভিযুক্তদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্রান্ডের পাঁচটি মোবাইল, দুটি চাবির ছড়া, ওই কক্ষের একটি তালা, একটি ল্যাপটপ, একটি ইউএসবি ক্যাবলের সঙ্গে চিপস, একটি রাউটার, দুটি ইউএসবি হাফ ও তালা খোলার জন্য পাঁচ ইঞ্চি সাইজের একটি মাস্টার চাবি জব্দ করা হয়।

এ ঘটনায় কাস্টমস হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মহসিন বাদী হয়ে নগরের বন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এতে উল্লেখ করা হয়- রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশে, রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়কে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশে, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশে, জনসাধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি সরবরাহে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশে, রাজস্ব আয়কে বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করার উদ্দেশে, রাজস্ব প্রশাসন বা রাজস্ব সংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলার রক্ষণাবেক্ষণ কাজে হস্তক্ষেপ করার উদ্দেশে, রাজস্ব আয়কে বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা প্রতিরক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশে কাস্টমস হাউসের অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গা অপারেশনাল ম্যানেজারের কক্ষে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে অভিযুক্তরা।

জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাইদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ধারণা করছি, অভিযুক্তরা অনেক বড় পরিকল্পনা নিয়ে ঢুকেছিল। কারণ এটা সাধারণ কিছু চুরির জায়গা না। আসামিরা যেখানে অনুপ্রবেশ করেছে সেটি সেনসিটিভ কক্ষ। 

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একাধিক চুরির মামলা রয়েছে উল্লেখ করে পুলিশের এ কর্মকর্তা জানান, আসামিদেরকে দুদিন রিমান্ডে আনা হয়েছে। ওই সময় তাদেরকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু তারা মুখ খোলেনি। এজন্য পুনরায় পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। এটি আদালতে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা মামলাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার নুরুন নাহার লিলি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার পর থেকে আমি অন্য কক্ষে অফিস করছি। এর বেশি আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের আরেক ডেপুটি কমিশনার মুহাম্মদ মাহফুজ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মামলা করেছি। পুলিশ মামলা তদন্ত করছে। তারা অভিযুক্তদের একবার রিমান্ডে এনেছে। পুনরায় আবার রিমান্ড নিতে আবেদন করেছে। ঘটনা তদন্তে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করেছে। তারা এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। জমা দিলে বিস্তারিত জানা যাবে।

এমআর/এমজে