অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব কবীর মিলন/ ফাইল ছবি

‘তিন মাসে দুর্নীতি দূর করতে ১০ কর্মকর্তার উইং চান অতিরিক্ত সচিব’ - রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) মো. মাহবুব কবীর মিলনের উদ্ধৃতি দিয়ে এ খবর প্রকাশ করে দেশের একটি অনলাইন গণমাধ্যম। দুর্নীতি দূর করার এমন ইচ্ছেই কাল হলো তার। এ বক্তব্যের জন্য প্রথমে ওএসডি হন তিনি। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। সেই মামলায় দণ্ড হিসাবে এবার তাকে ‘তিরস্কার’ করেছে সরকার।

গত ১ মার্চ জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

‘তিন মাসে দুর্নীতি দূর করতে ১০ কর্মকর্তার উইং চান অতিরিক্ত সচিব’ শিরোনামে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১০ সৎ কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি উইং গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন আলোচিত অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব কবীর মিলন। এই উইং তিন মাসের মধ্যে দেশের সব খাতের দুর্নীতি দূর করবে বলেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তিনি।

ওই প্রতিবেদনে দেওয়া বক্তব্যে মো. মাহবুব কবীর মিলন বলেন, ‘আমি যদি প্রধানমন্ত্রীকে পেতাম তবে বলতাম, স্যার আমাকে ১০ জন অফিসার দেন। এদের আমি চুজ করব, এদের নিয়ে আমি একটা উইং করব। মানুষের চোখের পানি দূর করার জন্য সব মন্ত্রণালয়, সব দফতর, সব অধিদফতরের বিষয়গুলো অ্যাড্রেস করব আমরা ১০ জন।’

তিনি বলেন, ‘কেউ যদি বলে আমরা দুর্নীতি দূর করতে পারব না, কেউ যদি বলে সিন্ডিকেট ভাঙা যায় না, আমি ওটারই চ্যালেঞ্জ দিয়েছি— আমার তিন মাস সময়ই যথেষ্ট, যেকোনো ডিপার্টমেন্টের সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য। এনাফ টাইম। দেশের অনেক ডেভেলপমেন্ট আনা যাবে, অনেক পরিবর্তন আনা যাবে। পারা যায়, আমরা পারবই। করতে না পারলে যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নেব। এটা আমার খুব ইচ্ছা।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমাদের স্বাধীনতা দিতে হবে, জবাবদিহিতা থাকবে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে। অন্য কারও কাছে নয়। কেন এই কথাটা বলছি- নানা পারিপার্শ্বিকতা আমাদের কাজ করতে দেয় না। নানা কারণে করতে দেওয়া হয় না। সেখানে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, সেখানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।’

এমন বক্তব্যের পর গত ৬ আগস্ট রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের পদ থেকে তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় প্রবল আলোচনা। তবে এর তোয়াক্কা না করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। সেই মামলায় শাস্তি পেলেন আলোচিত এ কর্মকর্তা।

১ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাহবুব কবীরের উদ্ধৃতি দিয়ে গত ২৯ জুলাই জাগো নিউজ নামের অনলাইন পত্রিকায় ‘তিন মাসে দুর্নীতি দূর করতে ১০ কর্মকর্তার উইং চান অতিরিক্ত সচিব’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত ও প্রকৃত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র ব্যতীত পত্রিকায় প্রকাশিত এ লেখায় তার মনগড়া, ভিত্তিহীন ও সরকারের জন্য অস্বস্তিকর বক্তব্য প্রকাশিত হওয়া সরকারি কর্মচারী হিসেবে তার আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল হওয়ায় এবং তিনি সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদের কর্মকর্তা বিধায় রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর বিধি ৩(খ) অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়।’

এতে বলা হয়, ‘অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রুজু করা বিভাগীয় মামলায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ৫ নভেম্বর তারিখের ১৮৭ নম্বর সড়কে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী পাঠানোর মাধ্যমে তাকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ প্রদান করা হলে তিনি ১৫ নভেম্বর লিখিত জবাব দাখিল করে ব্যক্তিগত শুনানি প্রার্থনা করেন। বিভাগীয় মামলায় গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ব্যক্তিগত শুনানিতে মামলার অভিযোগ, উভয় পক্ষের বক্তব্য, দাখিল করা কাগজপত্র ও প্রাসঙ্গিক সকল বিষয়ে পর্যালোচনায় অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর বিধি ৩(খ) অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়।’

এতে আরও বলা হয়, ‘এ বিভাগীয় মামলায় আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এবং অভিযোগের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিক প্রশাসনিক বিষয়টি বিবেচনায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর বিধি ৪(ক) মোতাবেক তাকে ‘তিরস্কার’ নামের লঘুদণ্ড প্রধানের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে এ লঘুদণ্ড আরোপের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি সম্মতি জ্ঞাপন করেন। তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর বিধি ৩(খ) অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এবং অভিযোগের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি বিবেচনায় একই বিধিমালার বিধি ৪(ক) মোতাবেক তাকে তিরস্কার নামের লঘুদণ্ড প্রদান করা হলো।’

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আগে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছিলেন মাহবুব কবীর মিলন। এ পদে থাকার সময় হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে সর্বত্র ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে জোরালো ভূমিকা রেখে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি।

মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত ফরমালিন ব্যবহারের বিরুদ্ধেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। সেসব পদক্ষেপ ওই সময় প্রশংসা কুড়িয়েছিল। পাশাপাশি, খাদ্যমান পরীক্ষার নানা ধরনের আজগুবি দাবি করে প্রক্রিয়াজাত খাবারের লেভেলিং এবং বিজ্ঞাপন তৈরির পথ বন্ধেও মাহবুব কবীর মিলনের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।

২০২০ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদ থেকে তাকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। সে পদে বেশি দিন থাকতে পারেননি তিনি। ওএসডি হওয়ার পর এবার লঘুদণ্ড পেলেন সাধারণ মানুষের কাছে ‘সৎ’ হিসেবে পরিচিত আলোচিত এ কর্মকর্তা।

এসএইচআর/এসএসএইচ