বুধবার রাতে অভিযুক্ত তিনজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি

দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা তাদের। নজরদারির মাধ্যমে প্রথমে তারা জালিয়াতি করে গ্রাহকের পাসওয়ার্ড হাতিয়ে নেয়। এরপর নামে বেনামে অর্ধশত পোস্টপেইড সিম উত্তোলনের মাধ্যমে ট্রান্সফার করে কোটি টাকার লিমিট। সেই লিমিটের বিপরীতে অপারেটরের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না দিয়ে পোস্টপেইড সিমগুলো থেকে লিমিট ট্রান্সফার করে বিভিন্ন দোকানের মাধ্যমে ফ্লেক্সিলোড ও ইন্টারনেট প্যাকেজ হিসেবে বিক্রি করে হাতিয়ে নেয় প্রায় কোটি টাকা।

এমন অভিনব প্রতারণা হয়েছে গ্রামীনফোনের (জিপি) অর্ধশত পোস্টপেইড সিম ব্যবহার করে। এ প্রতারণায় জড়িত দেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল অপারেটর কোম্পানি গ্রামীনফোনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান জিনিক্স ইনফোসিস লিমিটেড ও উইপ্রো লিমিটেড কল সেন্টারের পাঁচ কর্মী।

প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে গ্রামীনফোন অপরাধীদের শনাক্তে রাজধানীর ভাটারা থানায় গত ১ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে। মামলা নং ৪/৪০৬। মামলাটি তদন্ত করে সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট।

তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এজাহারনামীয় আসামি শুভ্রদেব চক্রবর্তী (২৪), রাজু সরকার (২৬) ও মো. মিজানুর রহমান (৪২) নামে তিনজনকে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে বুধবার গভীর রাতে গ্রেফতার করে সিআইডি। গ্রেফতারদের কাছ থেকে ৪টি মোবাইল সেট ও ১টি ল্যাপটপ জব্দ করা হয়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জিসানুল হক জানান, জিনিক্স ইনফোসিস লিমিটেড ও উইপ্রো লিমিটেড গ্রামীনফোনের কল সেন্টার পরিচালনার জন্য থার্ড পার্টি হিসাবে সার্ভিস প্রদানে চুক্তিবদ্ধ। আর গ্রেফতার আসামিরা ওই কল সেন্টারগুলোর কর্মী। সংশ্লিষ্ট অপারেটরের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ডাটাবেজে তাদের প্রবেশাধিকার ছিল। ওই সিস্টেম ব্যবহার করে গ্রাহকের সিমের মালিকানা পরিবর্তন, পোস্টপেইড সিমের ক্রেডিট লিমিট বাড়ানোসহ বিভিন্ন সার্ভিস প্রদান করা হতো।  ২০১৯ সালের আগস্টে কল সেন্টারে কর্মরত আসামিরা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করে ১৬টি পোস্টপেইড সিমের ক্রেডিট লিমিট বাড়িয়ে প্রায় ১৩ লাখ টাকা ট্রান্সফার করে আত্মসাৎ করে। পরবর্তীতে ওই বছরের অক্টোবরে এবং ২০২০ সালের জানুয়ারিতে অপর একটি রিটেইলারের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে একইভাবে ১১টি পোস্টপেইড সিমের ক্রেডিট লিমিট বাড়িয়ে আরও ৭২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের পক্ষ থেকে ভাটারা (ডিএমপি) থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে মামলাটি সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার তদন্ত শুরু করে।

তিনি বলেন, তদন্তকালে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় তিনজনকে গ্রেফতার করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ঘটনার মূলহোতা রাজু সরকার মোবাইল অপারেটরের সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করে পোস্টপেইড নাম্বারে লাখ লাখ টাকার ক্রেডিট লিমিট বাড়িয়ে নিতেন। ওইসব পোস্টপেইড নাম্বারগুলো আসামি ও তাদের সহযোগীরা ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে রাজু সরকার তার অপর সহযোগীদের মাধ্যমে গ্রামীন এলাকার বিভিন্ন গ্রাহকদের কাছে অবৈধভাবে ৫০০ ও ১০০০ মিনিটের প্যাকেজ, ইন্টারনেট প্যাক বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ টাকা নির্দিষ্ট হারে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করতেন। মামলাটির তদন্ত অব্যাহত আছে। মামলার সঙ্গে জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

এ ব্যাপারে সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তদন্তে জানা গেছে, গ্রামীনফোনের ৪৮টি পোস্টপেইড সিম উত্তোলন ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ অভিনব প্রতারণা হয়। গ্রেফতার প্রতারক তিনজনই গ্রামীণফোনের মিরপুর শাখায় কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি তারা এই প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পাশেই একটি ভবনে অফিস পরিচালনা করে আসছিলেন তারা।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিটির থার্ড পার্টি সাপোর্ট প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জিনিক্স ইনফোসিস লিমিটেড ও উইপ্রো লিমিটেড। তাদের সিস্টেমে প্রবেশের অনুমতি আছে। ধরুন, একজন শিল্পপতির পোস্টপেইড সিমের লিমিট এক লাখ। কথা বলতে বলতে কখনো কখনো লিমিট পেরিয়ে যায়। তবে কল সুবিধা অব্যাহত থাকে। সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ব্যাংকে ওই পোস্টপেইড ইউজার টাকা জমা দিলে সেটা এডজাস্ট হতে দুতিন দিন সময় লাগে। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় প্রতারকরা।  তারা প্রথমে কিছু পোস্টপেইড সিম কিনে। আবার অফিসে থাকা অবস্থায় পোস্টপেইড ইউজার কি ধরনের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন তা জানার চেষ্টা করে। এ রকম দু-তিনটি পোস্টপেইড ইউজারের পাসওয়ার্ড জেনে আইডি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় তারা। সেই আইডি ব্যবহার করে তাদের ক্রয়কৃত পোস্টপেইড সিমে বিপুল পরিমাণ টাকা ট্রানজেকশন করে অফিস ত্যাগ করেন। শুক্রবার রাত ও শনিবার সারাদিন তারা ওই সিমগুলো থেকে আবার টাকা বিভিন্ন গ্রাহকের নাম্বারে ট্রানজেকশন করে উত্তোলন করে নেয়।

যে প্রক্রিয়ায় পোস্টপেইড সিমগুলো থেকে টাকা উত্তোলন করে তারা

পোস্টপেইড সিমে ট্রানজেকশন করা টাকা উত্তোলনের জন্য বিভিন্ন ফ্লেক্সিলোডের দোকানের মালিকের সঙ্গে তাদের চুক্তি থাকে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মিনিট ও ইন্টারনেট প্যাকেজ বিক্রি বাবদ তারা ওই টাকা ব্যবহার করে। এজন্য তারা ফ্লেক্সিলোডের দোকানদারদের শতকরা ১০ শতাংশ লাভ দিয়ে সিমগুলো বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করে।

যেভাবে ধরা পড়ে সিমের লিমিট প্রতারণা

মোবাইল অপারেটর কর্তৃপক্ষ যখন দেখে যে, ওই সব পোস্টপেইড সিমে ট্রানজেকশন হওয়া টাকাগুলো তাদের ব্যাংকে জমা পড়েনি তখন তারা পুনরায় বিষয়টি খতিয়ে দেখে। যখন তারা বুঝতে পারে প্রতারণা হয়েছে তখন সিমের লিমিটের টাকা জব্দ করে দেয়। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। এ সময়ের মধ্যেও তারা বিপুল পরিমাণ টাকা আটকাতে সমর্থ হয়। যদিও এরই মধ্যে প্রতারক চক্রটি প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হয়। চক্রটি ৫০টি সিম থেকে এক হাজারের বেশি সিমে এইভাবে ট্রানজেকশন করে টাকাগুলো হাতিয়ে নেয়। মোবাইল অপারেটর কোম্পানিটি প্রথম অভিযোগ করে ১২টি সিমের বিপরীতে। তবে তদন্তে বের হয় প্রায় ৫০টি সিমের তথ্য। গ্রেফতার তিনজন প্রাথমিকভাবে সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন।

জেইউ/এসকেডি