বেতনের সিংহভাগ যাচ্ছে বাড়িভাড়ায়, তবুও হারছে ভাড়াটিয়াই
নতুন স্পন্দন, নতুন আশা ও নতুন সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর। আর নতুন বছরের প্রথম দিনেই রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়, অলিগলিতে দেখা গেছে ভাড়াটিয়াদের বাসা পরিবর্তনের দৃশ্য। কোনো ভাড়াটিয়া পিকআপে করে, কেউ বা ট্রাকে, কেউ কেউ ভ্যানগাড়িতে মালামাল নিয়ে তাদের বাসা পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।
বাসা পরিবর্তনের কারণ—বছরের শুরুতে বেড়েছে বাড়িভাড়া। নতুন বছর উপলক্ষে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়েছেন বাড়ি মালিকরা। আর এতেই হয়েছে আয়-ব্যয়ের অসংলগ্নতা। ফলে কিছুটা কম ভাড়ার কোনো বাসায় থাকতে রাজধানীর অন্য কোনো কম চাহিদা সম্পন্ন এলাকায় চলে যাচ্ছেন তারা। রাজধানীতে বসবাসরতদের বাসাভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে আয়ের সিংহভাগই চলে যায়। এরপরও নতুন বছর উপলক্ষে আরেক দফা বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন অনেক বাড়িওয়ালা। যে কারণে বাধ্য হয়ে অনেকেই বাসা ছেড়ে দিয়ে তুলনামূলক কম ভাড়ায় বাসা নিচ্ছেন। ফলে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, বেতনের সিংহভাগ টাকা বাড়িভাড়ায় পরিশোধ করেও বারবার হেরে যেতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াকেই। বাড়িওয়ালাদের কাছে হেরে গিয়ে বারবার বাসা পরিবর্তন করতে হচ্ছে কোনো রকমে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এসব মানুষদের।
বিজ্ঞাপন
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৬২৮ শতাংশ। গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া সংক্রান্ত জরিপে সংগঠনটি জানিয়েছিল, এ সময় বাড়িভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ।
সংগঠনটির অন্য এক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা শুধুমাত্র বাসাভাড়া পরিশোধে ব্যয় করে থাকেন।
রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় একটি ৬ তলা ভবনের ৫ম তলায় পরিবারসহ ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী হেদায়েতুল্লাহ। একটি কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করেন তিনি। মাস শেষে বেতন পান ৩৫ হাজার টাকা। শেওড়াপাড়ার বাসাটিতে প্রতিমাসে ভাড়া দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ডিস, ময়লা ও দারোয়ানসহ আরও তিন হাজার টাকা যুক্ত হয়। ফলে বাসাভাড়া বাবদ তার প্রতিমাসে ১৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। এ অবস্থায় নতুন বছরে এসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে জানুয়ারি থেকে আরও ১ হাজার টাকা ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ দিয়েছিলেন বাড়ির মালিক। যা হেদায়েতুল্লার জন্য বাড়তি চাপ হয়ে যাচ্ছিল। সে কারণেই নতুন বছরের প্রথম দিনে বাসা পরিবর্তন করে মোহাম্মদপুরের বসিলায় চলে যাচ্ছেন তিনি।
আলাপকালে হেদায়েতুল্লাহ বলেন, আমার বেতনের সিংহভাগই বাড়ি ভাড়ায় চলে যাচ্ছে। এছাড়া খাওয়া খরচ, সন্তানদের লেখা পড়া, যাতায়াত ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে টিকে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে আবার এক হাজার টাকা বাসাভাড়া বাড়লে তা আমার জন্য আরও কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। যে কারণে দুই হাজার টাকা কম খরচে আরও দূরে বসিলা এলাকায় একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। আমার অফিস ফার্মগেট হওয়ায় যদিও বাসা অনেক দূরে হয়ে যাবে, তবুও যেতে হচ্ছে। আমাদের মতো যারা ভাড়াটিয়ারা আছে, তারা মাসের ইনকামের বা বেতনের সিংহভাগই বাড়ির মালিকের হাতে তুলে দেই। তবুও আমাদের বারবার হেরেই যেতে হয়।
এতদিন রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় থাকতেন বেসরকারি চাকরিজীবী বিদুৎ সরকার। তবে বছরের প্রথম দিন বাসা পরিবর্তন করে আরও ভেতরের এলাকা ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের দিকে চলে যাচ্ছেন তিনি।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, বেতন যা পাই তা দিয়ে বাসাভাড়া পরিশোধ করার পর যা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়েই পুরো সংসার চালাতে হয়। এ অবস্থায় এসে যখন বাড়িওয়ালারা নতুন করে বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেন, তখন এই ইফেক্ট পুরো জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর পড়ে। তখন আমরা খুঁজি কোথায় আরেকটু কম ভাড়ায় বাসা পাওয়া যাবে। এতে করে যখন আরও ভেতরের দিকে চলে যাই, তখন অফিস হয়ে যায় দূরে। তবুও কষ্ট করেই কোনো রকমে জীবন-যুদ্ধে টিকে থাকতে হয়।
রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় ৫ তলা একটি বাড়ির মালিক সাদেকুর রহমান। নতুন বছর উপলক্ষে বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন তিনি। ফ্ল্যাটের অবস্থান ভেদে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা ভাড়া বাড়িয়ে গত ডিসেম্বরেই ভাড়াটিয়াদের নোটিশ দিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে সাদেকুর রহমান বলেন, বাজারে প্রতিটি জিনিসের দামের ঊর্ধ্বগতি, ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু আমরা যারা বাড়ির মালিক হয়েছি তারা নানান লোন করে ও ধার করে বাড়ি করেছি। আমাদের তো আয়ের পথ এই বাড়িভাড়া থেকেই। সবকিছুর দাম বাড়ছে, হোল্ডিং ট্যাক্সসহ বাড়ি পরিচালনা করার এমন কোনো খাত নেই যা বৃদ্ধি পায়নি। এই অবস্থায় বছরে একবার সামান্য বাড়ি ভাড়া বাড়ানো ছাড়া আমাদের কোনো পথ নেই। যদিও গত দুই বছরে করোনার কারণে আমিসহ অনেক বাড়িওয়ালাই তাদের বাড়ি ভাড়া বাড়ায়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ অবস্থায় এসে নতুন বছরে বাড়িভাড়া বাড়ানো ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। অনেকের তো বেতন বাড়ে, ব্যবসা বাড়ে, সেই অনুযায়ী বছরে একবার কি বাড়িভাড়া বাড়ানো উচিত নয়?
ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাসাভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এছাড়া মানববন্ধনসহ নানান কর্মসূচি পালন করেছি। তবুও এই অসহায় ভাড়াটিয়াদের কোনো কথাই শোনা হচ্ছে না। বছর গেলেই নানা অযুহাতে বাসাভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া বাড়ির মালিকদের একটি রুটিনে পরিণত হয়েছে। এই শহরের প্রাণ ভাড়াটিয়ারাই। ঈদ আসলে বোঝা যায় ভাড়াটিয়ারা ছাড়া এই শহর কতটা নীরব। এত সংখ্যক ভাড়াটিয়া এই শহরে থাকেন অথচ তাদের পক্ষে কথা বলা ও উদ্যোগ নেওয়ার কোনো লক্ষণ কখনোই দেখা যায় না।
তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ছে, এর সঙ্গে বাসাভাড়া বেড়ে গেলে এ শহরে থাকা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে ভাড়াটিয়াদের রক্ষা করতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। রাজধানীর লাগামহীন বাসাভাড়া রোধে প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। ভাড়াটিয়াদের সমস্যা সমাধানে সিটি কর্পোরেশনের মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার দাবি জানান তিনি।
জানা গেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের আইনটি হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষার নানান বিষয় এখানে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে আইনটির বিন্দুমাত্র প্রয়োগ নেই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকায় বর্তমানে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। প্রতি বছর নতুন করে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ ঢাকায় আসেন। যা এক দিনের হিসাবে এক হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় অন্যতম স্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আয়তন ও জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ।
অন্যদিকে বাসাভাড়া বেড়ে যাবে সম্প্রতি এমন আশঙ্কা জানিয়েছিল রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটি জানিয়েছিল, নতুন ড্যাপে ঘোষিত ফ্লোর-এরিয়া রেশিও বা আয়তন অনুপাতে তলা কমানোর কারণে ঢাকায় বেশিরভাগ ভবন হবে ৪ থেকে ৫ তলা। ফলে আগামীতে আবাসন সংকট আরও প্রকট হবে। উচ্চহারে ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে এবং বাসাভাড়া আকাশচুম্বি হবে।
সেই সংবাদ সম্মেলনে রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ফিন্যান্স) প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, নতুন ড্যাপের কারণে মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন আরও কঠিন হয়ে যাবে। এক বছর আগে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আমরা যে শঙ্কার কথা বলেছিলাম সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। কারণ ফ্ল্যাটের চাহিদা এবং যোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে। নতুন ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর গত প্রায় চার মাসে রিহ্যাব সদস্যরা জমির মালিকের সঙ্গে কোনো চুক্তি বা সমঝোতায় যেতে পারেননি। কেউ নতুন করে প্ল্যান পাস করেননি। পুরাতন প্রকল্পগুলো নিয়েই অনেকে কাজ করছেন। ফলে আগামীতে ফ্ল্যাটের সংকট তৈরি হবে এবং দাম বাড়বে।
বিশ্লেষণ করে দেখে গেছে, আগে যেখানে জায়গার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে সুউচ্চ ভবনের অনুমোদন নেওয়া যেত, এখন নতুন ড্যাপের মাধ্যমে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলে সুউচ্চ ভবন নির্মাণে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রশস্ত রাস্তা না থাকলে আগের আটতলা ভবনের স্থানে এখন চারতলা ভবনের অনুমোদন মিলবে। মূলত এটি করার কারণ হচ্ছে, বিভিন্ন এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্বের অনুপাত সেখানকার নাগরিক সুবিধার বিবেচনায় রেখে ঢাকাকে একটি উন্নত বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলা।
বিষয়টির ব্যাখ্যা করে রিহ্যাবের সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন ড্যাপ অনুযায়ী সামনে যতটুকু প্রশস্ত রাস্তা আছে তার ওপর নির্ভর করে প্ল্যান পাওয়া যাবে। আগে যদি একটি প্ল্যানে আটতলা পেতেন তাহলে নতুন ড্যাপের বিধি অনুযায়ী পাবেন তিন থেকে চারতলা। ফলে ফ্ল্যাটের কোয়ান্টিটি কমে যাচ্ছে। এ কারণে বাসাভাড়া বাড়বে তা মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। যারা স্বল্প বেতনে বেসরকারি চাকরি করেন, তাদের বেতনের ৬০ শতাংশ বাসাভাড়া পরিশোধ করতেই শেষ হয়ে যায়। এমন সব মানুষের স্বপ্ন থাকে সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনবেন। তবে নতুন ড্যাপের কারণে দাম বেড়ে গেলে সাধারণ এসব মানুষের পক্ষে আর ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে ফ্ল্যাটের বা বাসাভাড়াও বৃদ্ধি পাবে।
এএসএস/কেএ/এনএফ