অপরিচ্ছন্ন শৌচাগারের দায় রোগীদের : কর্তৃপক্ষ
হাসপাতালের মতো জায়গা, যেখানে বহু লোকের যাতায়াত, সেখানে ফ্লোর, শৌচাগারসহ অন্যান্য স্থাপনা নোংরা হবে, এটাই স্বাভাবিক। তা পরিষ্কারের দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সেই দায় রোগীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বুধবার (১০ মার্চ) সকাল ৯টায় সরেজমিনে রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত দেশের একমাত্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিদর্শনে শৌচাগারগুলোর বেহাল অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। দুর্গন্ধে যেন বমি চলে আসে। অপরিষ্কার বেসিনগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় আয়নাতে দেখা যায় না নিজের চেহারা।
বিজ্ঞাপন
প্রত্যেকটা শৌচাগারে তিনটি করে টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। অধিকাংশ টয়লেটের অবস্থা খারাপ। কোনোটি ভাঙা, আবার কোনোটিতে নেই প্যান। টয়লেট সংকটের কারণে শৌচাগারের সামনে সবসময় দীর্ঘ লাইন লেগে থাকে।
হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ভবনের নিচতলা থেকে ছয়তলার মধ্যে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে হাসপাতালটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক। ওই সময় হাসপাতালের ফ্লোর, সিঁড়ি, বারান্দা, অপারেশন থিয়েটারের সামনের ওয়েটিং রুম অত্যন্ত বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু সে চিত্র এবার আর মেলেনি। ঝকঝকে ফ্লোর, পরিষ্কার সিঁড়ি, বারান্দাগুলোতে মেলেনি ঢাকনাবিহীন ডাস্টবিন। প্রতিটি ফ্লোরেই কিছু দূর পরপর রয়েছে ডাস্টবিন। সর্বত্র বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
প্রতিটি ফ্লোর পরিষ্কার, সিঁড়িগুলোও পরিষ্কার। কিন্তু সবচেয়ে অসুবিধা হয় ওয়াশরুমে গেলে। আপনি নিজেও দেখেছেন ওয়াশরুমের বেসিনগুলো নোংরা, অনেক টয়লেটে প্যান নেই। কেন যে এ বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আসে না, সেটা বুঝতে পারি না
ভুক্তভোগী রোগীর স্বজন
তবে অপরিবর্তিত রয়েছে হাসপাতালের শৌচাগারগুলো। হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা যে শৌচাগারগুলো ব্যবহার করছেন সেগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। এগুলোর প্রতি নজর নেই কর্তৃপক্ষের। বিষয়টি নিয়ে চরম বিরক্ত সেবা নিতে আসা মানুষগুলো।
ক্যান্সার চিকিৎসার একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন রোগীরা। সঙ্গে থাকেন তাদের স্বজনেরা। কিন্তু নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর শৌচাগারের কারণে তাদের ভোগান্তির মাত্রা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন তারা।
সিলেট থেকে আসা মাহমুদুল হাসান বাবার চিকিৎসার জন্য গত পাঁচ মাস ধরে নিয়মিত এ হাসপাতালে আসছেন। প্রতি মাসে অন্তত দুবার এসে দিন-তিনেক থাকতে হয় এখানে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ফ্লোর পরিষ্কার, সিঁড়িগুলোও পরিষ্কার। কিন্তু সবচেয়ে অসুবিধা হয় ওয়াশরুমে গেলে। আপনি নিজেও দেখেছেন ওয়াশরুমের বেসিনগুলো নোংরা, অনেক টয়লেটে প্যান নেই। কেন যে এ বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আসে না, সেটা বুঝতে পারি না। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ওয়াশরুম ব্যবহার করে। নোংরা হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা পরিষ্কারের দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই।’
কেউ যদি কমোডের ওপর পা তুলে বসে তাহলে ভাঙবে, এটাই স্বাভাবিক। এটার জন্য আমরা সুপারিশ করেছি সব প্যান বদলে দিতে। পানি আটকে থাকতে পারে। কমোডের মধ্যে মোবাইলফোনও পাওয়া গেছে। তাহলে বলেন, আমরা আর কী করতে পারি
ডা. মো. মুশতাক হোসেন, পরিচালক, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত প্রায় দুই হাজার রোগী এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সেই হিসাবে প্রতিদিনই হাসপাতালটিতে বিপুল পরিমাণ মানুষের সমাগম ঘটে। তাই শৌচাগারগুলো নোংরা হওয়াটা স্বাভাবিক।
এ বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মুশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কোথাও শৌচাগার অপরিষ্কার, এমন কোনো চিঠি পাইনি। যদি হয়ে থাকে বিষয়টা ইনচার্জকে জানাতে হবে। আমার পক্ষে পুরো হাসপাতাল প্রতিদিন ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। ফ্লোরের দুপাশে দুজন করে সুইপার আছে। আর এটা চালায় ওই ওয়ার্ডের ইনচার্জ।’
কমোড ভাঙা থাকার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি জানি। কেউ যদি কমোডের ওপর পা তুলে বসে তাহলে ভাঙবে, এটাই স্বাভাবিক। এটার জন্য আমরা সুপারিশ করেছি সব প্যান বদলে দিতে। পানি আটকে থাকতে পারে। কমোডের মধ্যে মোবাইলফোনও পাওয়া গেছে। তাহলে বলেন, আমরা আর কী করতে পারি?
আপনি যদি স্কয়ার হাসপাতালে যান, চারগুণ বেশি টাকা দিয়ে আপনাকে চিকিৎসা নিতে হবে। সঙ্গে তারা আপনাকে এক কাপ চাও পান করাবে। এখানে কেমোথেরাপিতে ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। স্কয়ারে যান তিন লাখ টাকা নেবে। ঝকঝকা টাইলস, দু-তিনবার ঝাড়ু দেওয়া পরিষ্কার পরিবেশ দিতে অসুবিধা কী
ডা. মো. মুশতাক হোসেন, পরিচালক, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
‘আমরা গণপূর্ত বিভাগকে বলেছি হাইকমোডগুলো পরিবর্তন করে দিতে। হাইকমোড প্রতিটি ফ্লোরে একটা থাকবে, তালাবদ্ধ অবস্থায়। বাংলা প্যানে বসতে কারও অসুবিধা হলে তাকে সেটি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হবে। গণপূর্ত বিভাগ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। অনেক দূর এগিয়েও গেছে।’
বেসরকারি হাসপাতালের উদাহরণ দিয়ে মুশতাক হোসেন বলেন, মাসে অন্তত এক লাখ লোক এখানে আসা-যাওয়া করে। আপনি বিপুল সংখ্যক লোককে কীভাবে পরিষ্কার পরিবেশ দেবেন? আপনি যদি স্কয়ার হাসপাতালে যান, চারগুণ বেশি টাকা দিয়ে আপনাকে চিকিৎসা নিতে হবে। সঙ্গে তারা আপনাকে এক কাপ চাও পান করাবে। এখানে কেমোথেরাপিতে ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। স্কয়ারে যান তিন লাখ টাকা নেবে। ঝকঝকা টাইলস, দু-তিনবার ঝাড়ু দেওয়া পরিষ্কার পরিবেশ দিতে অসুবিধা কী!
প্রতিষ্ঠানটির উপ-পরিচালক (প্রশাসন) ডা. হেলিশ রঞ্জন সরকার বলেন, ধরেন একটা টয়লেট ১০০ জন ব্যবহার করে। এখন প্রথমজন যদি টয়লেট ব্যবহারের পর পানি না ঢালে, তাহলে তো পরের জন ব্যবহার করতে পারবে না। বিষয়টা এমনই। আমাদের পক্ষ থেকে শৌচাগার পরিষ্কার রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। তবে তাদের কাছ (রোগী ও তাদের স্বজন) থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এটার জন্য তারাই দায়ী।
এমএইচএন/এসকেডি