চিকিৎসার আশায় বেডের রোগী মেঝেতে
মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত সুন্দর আলী। দেখে বোঝার উপায় নেই তার বয়স ৫০। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া জীর্ণ শরীরে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আউটডোরের নিচতলায় ঠাঁই হয়েছে। বেডে নয় মেঝেতে। এক মাস ধরে হাসপাতালে অবস্থান করে চিকিৎসকের দেখা পেয়েছেন মাত্র একবার।
পেটের টিউমার অপারেশনের পর ক্যান্সার ধরা পড়ে কিশোরগঞ্জ থেকে আসা সুন্দর আলীর শরীরে। প্রথমে মিটফোর্ডে চিকিৎসা নিয়েছেন। সেখানকার চিকিৎসকের পরামর্শে গত ফেব্রুয়ারিতে আসেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। ততদিনে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে পুরো শরীরে।
বিজ্ঞাপন
শুধু সুন্দর আলীই নন, নানা বয়সী ক্যান্সারে আক্রান্ত ও সন্দিগ্ধ রোগীদের ভিড় এ বিশেষায়িত হাসপাতালে। মাত্র ৩০০ বেডের এই হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীর চাহিদা প্রায় ১৭০০। সে চাপ গিয়ে পড়ছে বেডের বাইরে হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরে, বারান্দা ও গেটে। অনেকে আবার হাসপাতালের বাইরে রাত কাটিয়ে চিকিৎসার আশায় সকালে ফিরে আসছেন এখানে
বুধবার সকাল ১০টায় হাসপাতালের আউটডোরের মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখা যায় সুন্দর আলীকে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ডাক্তার শুধু পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষা করাই, সে রিপোর্টও আসে দেরিতে। কিন্তু রিপোর্ট আর ডাক্তারকে দেখানো হয় না। ১৯ দিন আগে ডাক্তার দেখাইছি। ডাক্তার হাসপাতালে ভর্তির সিরিয়াল দিছে। কিন্তু বেড খালি নাই। তাই মেঝেতে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কখনও বারান্দায়, কখনও হাসপাতালের মেঝেতে থাকি। সিরিয়াল পাইলেও সিট পাই না। টাকা দিলে ঠিকই পাইতাম।’
শুধু সুন্দর আলীই নন, নানা বয়সী ক্যান্সারে আক্রান্ত ও সন্দিগ্ধ রোগীদের ভিড় এ বিশেষায়িত হাসপাতালে। মাত্র ৩০০ বেডের এই হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীর চাহিদা প্রায় ১৭০০। সে চাপ গিয়ে পড়ছে বেডের বাইরে হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরে, বারান্দা ও গেটে। অনেকে আবার হাসপাতালের বাইরে রাত কাটিয়ে চিকিৎসার আশায় সকালে ফিরে আসছেন এখানে।
বড় ভাই গেছে টিকিট কাটতে। এরপর ডাক্তার দেখাব। তখন ঠিক হবে কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। রোগীর যে ভিড় তাতে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারব কি না, জানি না। এর আগে আরও দুদিন এসেছি। কিন্তু দীর্ঘ সিরিয়াল সামলে ডাক্তারের দেখা পাইনি
ভুক্তভোগী ক্যান্সার রোগী
বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সরেজমিনে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, হাজারও রোগীর ভিড়। টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ সিরিয়াল। ১০ টাকায় টিকিট কেটে চিকিৎসকের চেম্বারে যাচ্ছেন রোগীরা। চেম্বারের সামনেও রোগীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। কম খরচে ভালো চিকিৎসার আশায় প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আসেন এই হাসপাতালে। কিন্তু জনবল ও শয্যা সংকটের কারণে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের।
রোগীদের অভিযোগ, শয্যা সংকটের কারণে ভর্তি রোগীও হাসপাতালের বেড পাচ্ছেন না। অনেকে আবার টাকা দিয়ে সিরিয়াল ভেঙে ঠিকই চিকিৎসা নিচ্ছেন, পাচ্ছেন বেড ও ওষুধ।
টিকিট কাউন্টারের সামনে কথা হয় আবুল কালাম নামে গাউছিয়া মার্কেটের এক দোকান কর্মচারীর সঙ্গে। ভোলার এ বাসিন্দা ক্যান্সারে আক্রান্ত ভাতিজা সাইফুলকে (১৬) নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল থেকে ভাতিজাকে নিয়ে এখানে এসেছি। রোগীকে বসিয়ে নিজেই দাঁড়িয়েছি দীর্ঘ লাইনে। সেই লাইন শেষ করে টিকিট পেলেও চিকিৎসক দেখাতে পারব কি না, জানি না।’
এখানে টাকায় অনেক কিছুই হচ্ছে। আমি তো খাবারই পাচ্ছি না। চিকিৎসা নাই, বেড নাই। হাসপাতালে পড়ে আছি এতিমের মতো। অনেক বলেছি, আমাকে একটু ভর্তি নেন। কিন্তু নিচ্ছে না
ভুক্তভোগী ক্যান্সার রোগী
মিষ্টির দোকানের কর্মচারী কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা মাখন (৪৫) ভাই, নানী ও স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় বহির্বিভাগের প্রধান ফটকেই বসে পড়েন তিনি। কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, ‘বড় ভাই গেছে টিকিট কাটতে। এরপর ডাক্তার দেখাব। তখন ঠিক হবে কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। রোগীর যে ভিড় তাতে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারব কি না, জানি না। এর আগে আরও দুদিন এসেছি। কিন্তু দীর্ঘ সিরিয়াল সামলে ডাক্তারের দেখা পাইনি।’
সরেজমিনে দেখা যায়, বহির্বিভাগের প্রতিটি মেঝেতে শুয়ে-বসে দিন পার করছেন অসংখ্য রোগী। তাদের অনেকে মাসের পর মাস চিকিৎসা নিচ্ছেন এখানে।
ফাইল গেলেও দেখা মেলে না চিকিৎসকের
সাতক্ষীরা থেকে ১০ দিন আগে এখানে আসেন ঝর্না বেগম (৪০)। ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ফাইল দিচ্ছি কিন্তু বারবার ফিরে আসে। চিকিৎসককে আর দেখানো হয় না। রক্ত দিয়েছি পাঁচবার। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল থেকে খাবার চেয়ে এনে খাচ্ছি। যদি টাকা দিতে পারতাম তাহলে হয়তো কাজ হতো। এখানে টাকায় অনেক কিছুই হচ্ছে। আমি তো খাবারই পাচ্ছি না। চিকিৎসা নাই, বেড নাই। হাসপাতালে পড়ে আছি এতিমের মতো। অনেক বলেছি, আমাকে একটু ভর্তি নেন। কিন্তু নিচ্ছে না।’
বাপ নাই। বাচ্চার মুখের দিকে চাইয়া পড়ে রইছি। আমরা যে অসুস্থ, এইহানে পড়ে রইছি দেহার কেউ নাই। যদি পাঁচ হাজার টাহা দিতাম তো কালই ভর্তি হইয়া গেছি, দেখতেন বেডও পাইয়া গেছি। টেহাই তো নাই দিমু কেমনে
ভুক্তভোগী রোগীর স্বজন
টেহা দিলে বেড পাইতাম, চিকিৎসাও হইতো
পাশেই নয় বছরের শিশু রাজিবকে নিয়ে মেঝেতে বসে ছিলেন শরীয়তপুর থেকে আসা নাছিমা বেগম (৪০)। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাপ নাই। বাচ্চার মুখের দিকে চাইয়া পড়ে রইছি। আমরা যে অসুস্থ, এইহানে পড়ে রইছি দেহার কেউ নাই। যদি পাঁচ হাজার টাহা দিতাম তো কালই ভর্তি হইয়া গেছি, দেখতেন বেডও পাইয়া গেছি। টেহাই তো নাই দিমু কেমনে?’
তিনি আরও বলেন, ‘পোলার গলায় ক্যান্সার হবার পর তিনবার সার্জারি করছে। ছয়বার কেমো দেওয়ার পর সুস্থ হইছিল। আবার অসুস্থ হওয়ায় মাংস পরীক্ষা করছে, ওষুধ দিছে, কেমো দিছে। এখন সিভিসি টেস্ট দিছে।’
একই চিত্র হাসপাতালটির বহির্বিভাগের প্রত্যেকটি বিভাগে। সারাদেশের প্রায় ১৬ লাখ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সামলাতে হচ্ছে দাবি করে কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিদিন হাজারও রোগী সামলাতে হয় তাদের। যে পরিমাণ রোগী এখানে আসে তা সামলানোর মতো সক্ষমতা নেই আমাদের।
আমাদের এখানে শয্যার সংখ্যা ৩০০। গত এক মাসে চিকিৎসা দিয়েছি এক হাজার ৩৪৭ জনকে। প্রতিদিন যদি আমাদের ১০টি বেড ফাঁকা হয় তার বিপরীতে চাহিদা তৈরি হয় কমপক্ষে হাজারের। যে কারণে সিরিয়াল পেলেও একজন রোগী হয়তো ২০ দিনে ফাঁকা বেড পাচ্ছেন না। আমাদের তো সক্ষমতাই নেই
অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন, পরিচালক, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
এ বিষয়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মুশতাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের আউটডোরে গত ফেব্রুয়ারিতে চিকিৎসার জন্য টিকিট কেটেছেন ২১ হাজার ৮২৭ জন। এর বাইরে জরুরিভিত্তিতে ভর্তি নেওয়া হয়েছে ৩০৩ জনকে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন এখানও ৭৩৯ জন। ডে-কেয়ারের রেডিয়েশনে দুই হাজার ৯৪২ জন ও মেডিকেল অনকোলজি বিভাগে তিন হাজার ৫৬০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। খোঁজ নিয়ে দেখুন, অন্য যেকোনো হাসপাতালের চেয়ে কী পরিমাণ চাপ আমাদের সামলাতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে শয্যার সংখ্যা ৩০০। গত এক মাসে চিকিৎসা দিয়েছি এক হাজার ৩৪৭ জনকে। প্রতিদিন যদি আমাদের ১০টি বেড ফাঁকা হয় তার বিপরীতে চাহিদা তৈরি হয় কমপক্ষে হাজারের। যে কারণে সিরিয়াল পেলেও একজন রোগী হয়তো ২০ দিনে ফাঁকা বেড পাচ্ছেন না। আমাদের তো সক্ষমতাই নেই। মন্ত্রণালয়ে বেড বাড়ানোর আবেদন করেছি, জনবলের চাহিদা দিয়েছি। সেটা হলে চাপ কিছুটা হলেও সামলাতে পারব।’
জেইউ/এসকেডি/এমএআর/