দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক হত্যা মামলাসহ ১০টির বেশি মামলার দীর্ঘদিনের পলাতক মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি পলাশ গাজী ওরফে জালাল গাজী ওরফে দাঁত ভাঙ্গা পলাশকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

সোমবার (২৬ ডিসেম্বর) রাতে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৩ এর একটি দল।

র‌্যাব বলছে, বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় তিনি নারায়ণগঞ্জ, কাঁচপুর, উত্তরা ও শ্যামবাজারসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় বাসা বদল করে পলাতক জীবনযাপন করে আসছিলেন।

পলাতক থাকা অবস্থাতেও তিনি ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে দল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অপকর্ম করতেন। মূলত রাতে সিএনজি চুরি, ডিবি পরিচয়ে ডাকাতি এবং ভাড়ায় খুন ও মারামারি ছিল নিয়মিত ঘটনা। একাধিক মামলায় একাধিকবার কারাভোগ করেছেন পলাশ।

মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারি থানায় গভীর রাতে মুখোশ পরে একই পরিবারের চার জনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি পলাশ গাজী। এছাড়াও একাধিক মামলায় যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত তিনি। পলাশ পটুয়াখালীর বাউফল নেমদীর মো. চাঁন্দু গাজীর ছেলে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার পলাশ গাজী ২০১০ সাল থেকে ডাকাতি, মাদক, চুরিসহ বিভিন্ন অপকর্মে ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে কাজ করতেন।

২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারি এলাকায় মমতাজ উদ্দিন নামে একজন ব্যক্তির সঙ্গে তার ছোট ভাই সুলতান আহমেদকে খুন করার বিষয়ে চুক্তি হয়। সুলতান ও বড় ভাই মমতাজের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ চলে আসছিল। একপর্যায়ে মমতাজ ছোট ভাই সুলতানকে খুন করার জন্য পলাশ ও তার বাহিনীকে পাঁচ লাখ টাকা ও ভুরুঙ্গামারি থানায় এক বিঘা জমি লিখে দেওয়ার বিনিময়ে চুক্তি করেন।

মমতাজের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার পর পলাশের নেতৃত্বে নজরুল ওরফে মনজু, আমির, জাকির, জালাল ওরফে পলাশ, হাসমত ও মমতাজসহ ছয়জন ২০১৪ সালে ১৩ জানুয়ারি গভীর রাতে ভুরুঙ্গামারি উপজেলার দিয়াডাঙ্গা গ্রামে মমতাজের নিজ বাড়িতে বসে সুলতানকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৪ জানুয়ারি রাতে পলাশের নেতৃত্বে অন্য সহযোগীরা মুখোশ পরে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সুলতানের বাড়িতে দল বেঁধে হামলা চালায়। প্রথমে তারা সুলতানের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে তার মুখমণ্ডলসহ সারা শরীরে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে।

এসময় তার স্ত্রী হাজেরা বেগম বাধা দিলে তাকেও পিঠে এবং পেটে ধারালো রামদা দিয়ে কোপানো হয়। এরপর সুলতানকে তারা আবারও এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।

শব্দ শুনে পাশের ঘর থেকে দুই নাতনি রুমানা ও আনিকা ছুটে এসে বাধা দিলে তাদেরও বুকে এবং পেটে-পিঠে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এভাবে তারা একই পরিবারের চার জনকে কুপিয়ে হত্যা করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে।

ঘটনার পরদিন সকালে নিহত সুলতানের ছেলে হাফিজুর রহমান বাদী হয়ে ভুরুঙ্গামারি থানায় কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। ঘটনার কিছুদিন পর ভুরুঙ্গামারি এলাকায় অন্য একটি হত্যা মামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুই জনকে গ্রেপ্তার করে।

জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা সপরিবারে সুলতান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে এবং তাদের সঙ্গে জড়িতদের নাম প্রকাশ করে, যেখান থেকে গ্রেপ্তার পলাশ গাজীর নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা মমতাজ উদ্দিন, পলাশ গাজীসহ সাত জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত গত ১৬ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্ত মমতাজ উদ্দিন, পলাতক পলাশ গাজীসহ ছয় জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং একজনকে খালাস প্রদান করেন। রায় ঘোষণার দিন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ছয় জন আসামি আদালতে উপস্থিত থাকলেও পলাশ গাজী ঘটনার পর থেকেই পলাতক ছিল।

এছাড়াও ২০১৫ সালের জুলাই মাসে বগুড়ার শেরপুরের মির্জাপুর এলাকায় মাইক্রোবাস চুরির উদ্দেশে মাইক্রোবাসের চালক নুরুল হককে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে পলাশ গাজী ও তার সহযোগীরা। পরে মরদেহ বগুড়ার শেরপুরের মির্জাপুর এলাকায় একটি পুকুরে ফেলে রাখে তারা।

ওই হত্যার ঘটনায় ২০২২ সালের নভেম্বরে আদালত পলাশ গাজীসহ ৯ আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেন। সাজাপ্রাপ্ত ৯ আসামির মধ্যে পলাশ গাজী, নজরুল ইসলাম মনজু এবং আমির হামজা ২০১৪ সালের কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারি এলাকায় একই পরিবারের চার জনকে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের মামলারও আসামি ছিলেন।

এছাড়াও পলাশ গাজীর বিরুদ্ধে পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানায় ২০১৫ সালে হত্যাচেষ্টা মামলা, গাজীপুরের কালীগঞ্জ সড়কে ২০১৫ সালে ডাকাতির প্রস্তুতির মামলা, রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় ২০১৬ সালের ডিবি পরিচয়ে একটি ডাকাতি ও একটি অস্ত্র মামলা, ২০১৭ সালে চুরি ও ভাঙচুরের দুটি মামলা এবং রাজধানীর চকবাজার থানায় ২০১৯ সালে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে একটি হত্যা মামলাসহ মোট ১১টি মামলা রয়েছে।

কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তার পলাশ গাজীর কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। সে ১৯৯০ সাল থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে একটি গ্যারেজে কাজ করত। পরে ট্রাকের হেলপারির পাশাপাশি মাঝে মাঝে চালকের ভূমিকা পালন করতেন।

পলাশ ১৯৯৫ সাল থেকে লাইসেন্স ছাড়া কাভার্ডভ্যান চালাতেন। পেশায় মূলত একজন ড্রাইভার হলেও ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা ছিল।

২০০৯ সালে তিনি একটি পুরোনো মাইক্রোবাস কেনে চালানো শুরু করেন। মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় মাদকের চালান সরবরাহ করতেন।

এছাড়াও ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ২০১০ সালে তার নেতৃত্বে কয়েকজন সহযোগীসহ তিনি ভাড়াটে সন্ত্রাসীর একটি দল তৈরি করে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলার মহাসড়কে ডাকাতি, খুন, মারামারিসহ নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম চালাতেন।

বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা এবং ওয়ারেন্ট থাকায় তিনি নারায়ণগঞ্জ, কাঁচপুর, উত্তরা ও শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় বাসা বদল করে পলাতক জীবনযাপন করে আসছিলেন। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

জেইউ/এসএসএইচ/