১৫ বছর আগে রিকশা চুরি, বদলা নিতে গিয়ে এখন চোরচক্রের প্রধান
১৫ বছর আগে কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন কমল নামে এক যুবক। একদিন তার রিকশাটি চুরি হয়ে যায়। সেই রিকশার মালিককে মূল্য পরিশোধ ও চুরির বদলা নিতে গিয়ে তিনিই এখন বনে গেলেন চোর চক্রের প্রধান।
রাজধানীর খিলগাঁও এবং সবুজবাগ থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪টি চোরাই অটোরিকশা জব্দ ও চক্রের ৬ সদস্যকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা। এরপরই বেরিয়ে আসে চক্রের প্রধান কমলের কাহিনী।
বিজ্ঞাপন
রোববার (২৬ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর খিলগাঁও ও সবুজবাগ থানা এলাকায় বিভিন্ন গ্যারেজে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে র্যাব-৩।
আটকরা হলেন- সংঘবদ্ধ রিকশা চোর চক্রের প্রধান কামাল হোসেন কমল (৩৫), সহযোগী মো. রাশেদ (২৮), আলম হাওলাদার (৩৬), মো. কাজল (৩৬), মো. ফজলু (৩০), মো. সাজু (২৫)। এসময় তাদের কাছ থেকে ১৪টি অটোরিকশা ছাড়াও, ১৮টি অটোরিকশার চার্জার, ব্যাটারি ও ৬টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
গত ৭ বছরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা চুরি ও ছিনতাই করেছে এ চক্রটি।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, রাজধানীর খিলগাঁও ও সবুজবাগ থানা এলাকায় বিভিন্ন গ্যারেজের সংঘবদ্ধ চোর চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন যাবৎ সক্রিয় বলে গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে র্যাব। অভিযোগ ছিল- চোরাই ও ছিনতাই করা বিভিন্ন রংয়ের ব্যাটারিচালিত রিকশা মজুদ ও রং পরিবর্তন করে বিক্রয় করে আসছে চক্রটি।
সুনির্দিষ্ট এসব তথ্য ও গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে আটক করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রের প্রধান কমল। তিনি ১৫ বছর আগে কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন। একদিন তার রিকশা চুরি হয়ে যায়। তারপর রিকশার মালিক তার কাছ থেকে চুরি যাওয়া রিকশার মূল্য আদায় করেন। ঋণ করে চুরি যাওয়া রিকশার মূল্য মালিককে পরিশোধ করে কমল। ওই ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে চুরি যাওয়া রিকশা খুঁজতে থাকে। সেখান থেকেই অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন। এরপর নিজেই রিকশা চুরিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন।
জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব আরও জানতে পারে, ১২ বছর যাবৎ রিকশা চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি করে আসছে কমল। প্রথমে কমল নিজেই একা রিকশা চুরি করতো। নতুন রিকশায় উঠে চালককে বিষাক্ত কোমল পানীয় দিয়ে অজ্ঞান করে রিকশা নিয়ে পালিয়ে যেতো। আবার কখনও রিকশা চালক কোমল পানীয় খেতে রাজি না হলে তার নাকের কাছে চেতনানাশক ভেজানো রুমাল দিয়ে অজ্ঞান করে রিকশা চুরি করতো। এরপর সে রিকশা চুরির জন্য একটি চক্র গড়ে তোলে।
রিকশা চুরির অভিনব যত কায়দা
র্যাব জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়াতো চক্রটি। সাজু রিকশা চালাতো আর পথিমধ্যে নতুন রিকশার ওপর নজরদারি করতো। আর কমল রিকশার চালককে বলতো- সামনের রাস্তায় একটি বাসা থেকে আমার কিছু মাল তুলবো। এরপর নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব দিতো তারা এবং রিকশা চালকের কাছ থেকে তার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতো। বেশি ভাড়া পাওয়ার লোভে রিকশা চালক তাদের কথায় রাজি হতো। তারপর সুবিধামতো একটি বাসার সামনে রিকশা থামিয়ে চালককে বলতো আপনাকে বাসার ভেতরে ঢুকে মালামাল নিয়ে আসতে হবে। রিকশার চালক বাসার ভেতরে প্রবেশ করতেই চক্রের অপর সদস্য ফজলু গাড়ি নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতো। তখন কমল রিকশা খোঁজার নাম করে তাদের চক্রের রিকশা নিয়ে পালিয়ে যেতো।
এরপর এসব চুরি যাওয়া রিকশা একটি গ্যারেজে নিয়ে লুকিয়ে রাখতো রাশেদ, আলম হাওলাদার ও কাজল। তারপর রিকশার মালিককে ফোন দিয়ে মুক্তিপণ দাবি করতো। মুক্তিপণের টাকা বিকাশের মাধ্যমে আদায় করা হতো। এরপর একটি অজ্ঞাত স্থানে রিকশা রেখে মালিককে রিকশা নিয়ে যেতে বলতো তারা।
এই কৌশলে একাধিক চুরির পর সহযোগিসহ বেশ কয়েকবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয় চোর চক্রের সদস্যরা। তারপর চুরির কৌশল পরিবর্তন করে তারা। পরবর্তী সময়ে তারা বেশি ভাড়ায় একটি রিকশায় চড়ে চালককে নির্জন স্থানে নিয়ে মারধর করতো। এরপর চালককে হাত পা বেঁধে রিকশা নিয়ে পালিয়ে যেত। চুরির পর রিকশার রং পরিবর্তনের পর খোলা বাজারে বিক্রি করে দিত চক্রটি। কখনও রিকশার মোটর পার্টস খুলে আলাদা আলাদাভাবে বিক্রয় করতো তারা।
জানা যায়, চক্রের মূলহোতা কমল রিকশা চুরির মূল পরিকল্পনাকারী। তার নেতৃত্বে রাস্তায় নজরদারি করে টার্গেট নির্ধারণ করা হতো। কমল টার্গেটের সঙ্গে কথা বলে রিকশার ভাড়া ও গন্তব্য নির্ধারণ করতো। তার সহযোগী সাজু চোরাই রিকশা চালিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতো। অন্যতম আরেক সহযোগী ফজলুরের সহায়তায় চোরাই হওয়া ব্যাটারিচালিত রিকশার রং, সিট কাভার পরিবর্তন করে বিভিন্ন লোকজনের কাছে বাজার দামের অর্ধেক দামে বিক্রয় করে দিতো। রিকশা চুরির উপযুক্ত স্থান হিসেবে বাসাবো বাস স্ট্যান্ড এলাকা, মান্ডা এলাকাকে বেছে নিতো তারা। ৫-১২ হাজার টাকায় বিক্রি হতো এসব রিকশা।
র্যাব আরও জানায়, কমলের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৮টি চুরি মামলা ও ফজলুর নামে ১ টি চুরি ও ১ টি মাদক মামলা রয়েছে। আটকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এমজে/এসএম