পদ্ধতিগত কারণেই কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা পালাতে সক্ষম হন
পদ্ধতিগত কারণেই বড় বড় কেলেঙ্কারি বা দুর্নীতিতে জড়িত কোনো কোনো অপরাধী দেশ থেকে পালাতে সক্ষম হচ্ছেন। এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটা বৈশ্বিক। বিশ্বায়নের যুগে এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষের যাতায়াতের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। এসব তারই অংশ।
এমনটাই দাবি করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। দীর্ঘ পাঁচ বছর যিনি প্রতিষ্ঠানটির চতুর্থ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিজ্ঞাপন
ইকবাল মাহমুদ ১৯৫৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মোহাম্মদ আবদুল লতিফ ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। ১৯৭২ সালে তিনি সাতক্ষীরার আশাশুনি হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৭৪ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনপ্রশাসনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পরও অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে পলিসি স্টাডিজে আরেকবার মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি জনপ্রশাসনে পিএইচডি শেষ করেন। ইকবাল মাহমুদ ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসনে কর্মজীবন শুরু করার পর ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করার পর ২০১৬ সালের ১০ মার্চ দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান।
৯ মার্চ ছিল দুদকে তার শেষ কর্মদিবস। দায়িত্ব পালনকালে কর্মজীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন ইকবাল মাহমুদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এফ এম আবদুর রহমান মাসুম।
ঢাকা পোস্ট: দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় আপনার পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন।
ইকবাল মাহমুদ: দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে আমি আমার আইনি দায়িত্ব পালন করেছি। এ দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে আমরা পাঁচ বছর মেয়াদি (২০১৭-২০২১) কর্মকৌশল প্রণয়ন করি। এ কর্মকৌশল প্রণয়নে সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম, শিক্ষক, উন্নয়ন সহযোগী, রাজনীতিবিদ, এনজিও সবার সঙ্গে আলোচনা করা হয়। যাতে তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে বহুমাত্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যা আপনারা নিয়মিত গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। দুদকের অভিযোগকেন্দ্রের হটলাইন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট, গোয়েন্দা ইউনিট, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা, সততা স্টোর এমন অসংখ্য কার্যক্রম আমরা বাস্তবায়ন করেছি।
ঢাকা পোস্ট: আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর আসামি গ্রেফতার ও ফাঁদ মামলা অনেক বেড়েছিল। আপনার মেয়াদের শেষ সময়ে এ কার্যক্রম খুব বেশি চোখে পড়েনি কেন?
ইকবাল মাহমুদ: বিগত পাঁচ বছরে প্রায় এক হাজার আসামি গ্রেফতার করেছে দুদক। এমনকি করোনা মহামারিতেও দুদকের এসব অভিযান বন্ধ হয়নি। বেশকিছু ফাঁদ মামলাও হয়েছে। অনেক আসামি স্বেচ্ছায় আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে সব কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দুর্নীতিপরায়ণদের কোনো ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দুদকের নেই।
ঢাকা পোস্ট: অনেক বড় বড় কেলেঙ্কারি ও অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলমান থাকলেও আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে তারা ঠিকই বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে। এর প্রধানতম কারণ কী?
ইকবাল মাহমুদ: এসব অপরাধী দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই থাকুক দুদক তাদের তাড়া করবে এবং করছে। আইনের কাছে তাদের সোপর্দ করা হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ অনুসন্ধানের আগেই হয়তো অপরাধীরা পালিয়ে যায়। পদ্ধতিগত কারণেই কোনো কোনো অপরাধী পালাতে সক্ষম হচ্ছেন। এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটা বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বায়নের যুগে এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষের যাতায়াতের যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, এসব তারই অংশ। তবে এ কথাও ঠিক, দুদকের মামলার যেসব আসামি বিদেশে পালিয়েছেন, তাদের দেশে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য দুদক চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। এখন এসব অপরাধীর আইন আমলে আনার জন্য আন্তর্জাতিক আইনি পরিকাঠামো রয়েছে। বিদেশে পালিয়ে থেকেও অপরাধীরা পার পাবেন বলে মনে হয় না।
ইকবাল মাহমুদ: সফলতা হচ্ছে দুর্নীতি করে পার পাওয়া যাবে, এ ধারণাগত অপসংস্কৃতি ভাঙতে বর্তমান কমিশন কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক কোনো প্রভাব আমাদের কর্মকালে অনুভব করিনি। আইনগতভাবেই কেউ দুদককে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায়নি। আমরা স্বাধীনভাবে বিবেক দ্বারা চালিত হয়েছি। কারো প্রতি রাগ-বিরাগ আমাদের কর্মপ্রক্রিয়ায় ছিল না। দুর্নীতি দমন বা নিয়ন্ত্রণ একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াকে শাণিত করতে যুগোপযোগী কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হয়। আগামীতে কমিশন তাদের কর্মপ্রিক্রিয়াকে আরও শাণিত করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি ।
ঢাকা পোস্ট: বিগত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান যাচাই-বাছাইকালে দেখা যায় অনুসন্ধানে পরিসমাপ্তি (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) ও মামলার এফআরটির হার অনেক বেশি। যা দুদকের ভাবমূর্তিকে বিতর্কিত করে বলে সাধারণ মানুষ মনে করেন। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
ইকবাল মাহমুদ: দুদকের দায়িত্ব দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান বা তদন্ত করে অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তের মাধ্যমে উপযুক্তভাবে আদালতে উপস্থাপন করা। দুদক তার এ আইনি দায়িত্ব নির্মোহভাবে পালন করছে। যারা অপরাধ করেছেন, তাদের আইনি আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। যারা অপরাধ করেননি তাদেরও আইনি প্রক্রিয়ায় অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট: বর্তমান দুদক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কতটুকু শক্তিশালী বলে মনে করেন? দুদকের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছেন?
ইকবাল মাহমুদ: দুদক স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইনগতভাবেই শক্তিশালী। তবে দুদককেও একটি আইনি প্রক্রিয়ায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রক্রিয়াগত কারণে সময়ের একটি বিষয় সামনে আসে। আমরা চেষ্টা করেছি দ্রুততম সময়ে অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে। দুদকের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতার বিষয়টি দুদক বিধি, ২০০৭ নিশ্চিত করা হয়েছে। এ বিধি অনুসারে দুদক কর্মকর্তাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিবীক্ষণ করা হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে যে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি রয়েছে, তা বিগত পাঁচ বছর যথেষ্ট সক্রিয় ছিল।
ঢাকা পোস্ট: আপনার একটি বক্তব্য বেশ আলোচিত ছিল, ‘দুর্নীতিবাজদের লোভের জিহ্বা কেটে দিতে চাই।’ এক্ষেত্রে বড় বড় দুর্নীতিবাজকে কতটুকু রুখতে পেরেছেন?
ইকবাল মাহমুদ: এটা প্রতীকী অর্থে আমি বলেছিলাম। তবে এ কথাও সত্য, দেশের উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন সব স্তরের অসংখ্য দুর্নীতিপরায়ণদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কেউ যে আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এটা প্রমাণে আমরা সফল হয়েছি।
ঢাকা পোস্ট: প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে অনেক কর্মকর্তাকে ডেপুটেশনে কাজ করতে দুদকে আনা হয়। কয়েক বছর অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে দক্ষতা অর্জন করার পর আবার নিজ দফতরে ফিরে যান তারা। এতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি? এর চেয়ে দুদকের নিজস্ব জনবলকে অধিক দক্ষ ও শক্তিশালী করার ওপর বেশি নজর দেওয়া উচিত কি না? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলছে?
ইকবাল মাহমুদ: দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮ অনুসরণ করেই কর্মকর্তাদের ডেপুটেশনে আনা হয়। তাদের অনেকে কর্মকালে দক্ষতার পরিচয় দেন। আবার যিনি কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেন না, তাকে কমিশনও দ্রুত মাতৃসংস্থায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এটা প্রশাসনিক ও প্রচলিত প্রক্রিয়া। দুদকের নিজস্ব জনবলকে আরও দক্ষ এবং শক্তিশালী করার লক্ষ্যেই এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দুদকে এমন কর্মকর্তা পাবেন না, যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
ঢাকা পোস্ট: আপনার দীর্ঘজীবন ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
ইকবাল মাহমুদ: আপনাকে ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভ কামনা।
আরএম/এসএম/এমএমজে