‘বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ নিখোঁজের পর থেকেই মেয়েটা হয়রানির শিকার। সুনির্দিষ্ট ক্লু ছাড়াই হত্যা মামলায় আসামি করে তাকে জেলে পাঠানো হলো। কিছু সময় একসঙ্গে কাটালেই কেউ খুনি হয়ে যায় না- এটা আমরা বলেছি, অনুরোধ করেছি, কিন্তু শোনা হয়নি। আমাদের মেয়েটার সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেল। ডিবি-র‌্যাব তো বলেছে, ফারদিন খুন হয়নি, আত্মহত্যা করেছে।’ 

রোববার ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা পোস্টের কাছে এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফারদিন হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরার চাচা মাজহারুল ইসলাম।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশ নিখোঁজের তিন দিন পর ৭ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা থেকে মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। সেসময় তার ব্যবহৃত ফোন, ঘড়ি ও মানিব্যাগ সঙ্গে পাওয়া যায়।

ফারদিনের পরিবার জানিয়েছিল, ৪ নভেম্বর বিকেল তিনটার দিকে বুয়েটের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন তিনি। ৫ নভেম্বর (শনিবার) সকাল ১০টায় পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষায় অংশ নেননি তিনি। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার নয়ামাটি গ্রামে। তারা রাজধানীর ডেমরার শান্তিবাগের একটি বাসায় থাকতেন।

ফারদিনকে খুন করা হয়েছে দাবি করে রামপুরা থানায় দায়ের করা মামলায় ‘হত্যা করে লাশ গুম’ করার অভিযোগ আনেন ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন। সেই মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয় বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাকে। ১০ নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৫ দিন রিমান্ডের পর এখন তিনি কারাগারে আছেন।

মামলার অভিযোগে ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বলেন, ফারদিনকে রামপুরা এলাকায় বা অন্য কোথাও হত্যাকারীরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। এ হত্যার পেছনের তার বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরার ইন্ধন রয়েছে।

৭ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। মরদেহ ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকরা জানান, ‘তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে’।

মামলার তদন্তভার ডিবি পুলিশের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এরপর মাদক সংশ্লিষ্টতা, মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে খুন, কিশোর গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতার বিষয় সামনে আসে। সর্বশেষ তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবি পুলিশ ও র‌্যাব তদন্ত অগ্রগতি নিয়ে এক ধরনের ‘সমঝোতা’য় পৌঁছে জানায়, স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ বা আত্মহত্যা করেছেন ফারদিন। ডিবি পুলিশ জানায়, ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনায় জেলে থাকা বুশরা নির্দোষ।

যোগাযোগ করা হলে বুশরার চাচা মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ফারদিনের বাবাকে বারবার বলেছিলাম, সন্দেহভাজন হিসেবে রাখতে পারেন সর্বোচ্চ, এক নম্বর আসামি কইরেন না। কিন্তু তিনি শোনেননি। তিনি এক নম্বর আসামিই করেন। বুশরাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়।’

তিনি বলেন, ফারদিন-বুশরার মধ্যে কখনো ফোনে কথা হয়নি। ফেসবুকে যোগাযোগ হতো। তারা দুজনই ডিবেট করত। ডিবেটের সূত্র ধরে নানা বিষয়ে যোগাযোগ হতো। বড় ভাই হিসেবে ফারদিনের কাছ থেকে ডিবেটের তথ্য-উপাত্তসহ নানা সহযোগিতা নিত বুশরা।

চাচা মাজহার আরও বলেন, ডিবি পুলিশ মামলা তদন্ত করছে। র‌্যাবও ছায়া তদন্ত করছে। আমরা ডিবি ও র‌্যাব উভয় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তারা আমাদের জানিয়েছেন বুশরা নির্দোষ। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের সময় ডিবি পুলিশ মামলা থেকে বুশরার নাম বাদ দেওয়ার কথা আমাদের জানিয়েছেন।

মাজহারুল ইসলাম বলেন, একটা ছেলে খুন বা মারা গেলে পরিবারের কী অবস্থা হয় সেটা বুঝি। ফারদিন তো নেই, মারা গেছে, সে তো আর ফিরবে না। কিন্তু বুশরা? বুশরা তো থেকেও আমাদের মাঝে নেই, নির্দোষ হয়েও জেল খাটছে। পরিবারের অবস্থাটা একবার বুঝুন!

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ পৌর শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বয়লা এলাকায় বসবাস করেন আমাতুল্লাহ বুশরার পরিবারের সদস্যরা। তার বাবা মঞ্জুরুল ইসলাম ওরফে সবুজ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। ২০১৭ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। মা ইয়াসমিন গৃহিণী।

তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় বুশরা। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করছেন। নিজে ডিবেট করেন, সেই সূত্রে আরেক ডিবেটার ফারদিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয় ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ থাকলেও প্রেম ছিল না বলে দাবি করেছে বুশরার পরিবার।

বাবা মঞ্জুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলেছি বুশরা নির্দোষ। এরপরও একটা মেয়ে হত্যা মামলায় আসামি হলো, জেলে গেল। আমাদের পুরো পরিবার এখন ট্রমায় ভুগছে। আমরা বুশরার সঙ্গে দেখা করেছি। বুশরাকে বিমর্ষ দেখেছি, ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। আমরা সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পাইনি।

তিনি বলেন, আজ তদন্তকারীরাই জবাব দিয়েছে, তারা বলেছে ফারদিন স্বেচ্ছায় মৃত্যু কিংবা আত্মহত্যায় মারা গেছে। যেটাই হোক, খুন হয়নি। মাঝখান থেকে আমার মেয়েটার জীবনটা ওলটপালট হয়ে গেল। ক্যারিয়ারটা ধ্বংস হয়ে গেল। এখনো মেয়েটা জেল খাটছে।

তিনি বলেন, আমরা আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, ডিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে কথা বলেছি। ঢাকা মহানগর আদালত এখন বন্ধ রয়েছে। খোলা মাত্র আমরা আর্জি করব। ডিবি পুলিশও মামলা থেকে বুশরার নাম বাদ দেওয়ার কথা বলেছে।

যোগাযোগ করা হলে মতিঝিল গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) রাজিব আল মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কিছু ফাইন্ডিংস বাকি আছে। সেসব শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করব।

জেইউ/এসএম