ইউএনওর গলাবাজি থেকে ‘জনস্বার্থে’ অবসর, আমলাতন্ত্রে ঘটনাবহুল ২০২২
আরও একটি বছর শেষ হতে চলেছে। বিদায়ী বছরটি ছিল প্রশাসনের জন্য ঘটনাবহুল। বাধ্যতামূলক অবসরের কারণে অনেকের আতঙ্কে কেটেছে এ বছর। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নাম জড়িয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। অপরাধের কারণে কয়েকজনের শাস্তিও হয়েছে। এছাড়া এ বছরেই দেওয়া হয়েছে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সে ৩৯ মাস ছাড়।
হঠাৎ বাধ্যতামূলক অবসরে আতঙ্ক, গুঞ্জন
২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনের। কিন্তু তার এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর হঠাৎ করে তাকে অবসরে পাঠায় সরকার।
বিজ্ঞাপন
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৫ অনুযায়ী জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হলো।
সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যেকোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কোনো কারণ না দেখিয়ে ওই কর্মচারীকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে। তবে শর্ত থাকে, যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হবে।
• আরও পড়ুন : ‘নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে কখনো কম্প্রোমাইজ করিনি’
অন্যদিকে, একই ধারায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলাদা প্রজ্ঞাপনে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবসরে পাঠানো হয়। তারা হলেন- পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী, মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার হোসেনের সই করা পৃথক তিনটি প্রজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এক। সবাইকে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮–এর ৪৫ ধারার বিধান অনুযায়ী জনস্বার্থে সরকারি চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়।
এই দুই ঘটনায় প্রশাসনজুড়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। ঠিক কোন ‘জনস্বার্থে’ চার কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়, সেটি খুঁজতে থাকেন অনেকে। এ ছাড়া চারদিকে চলে নানা গুঞ্জন।
সাংবাদিককে গালাগালি করে ওএসডি হন টেকনাফের ইউএনও
ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে সমালোচনার মুখে পড়েন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কায়সার খসরু। দুঃখ প্রকাশ করেও পদে থাকতে পারেননি তিনি।
গত ২১ জুলাই ‘নিচু জায়গায় নির্মাণ করা উপহারের ঘর পানিতে ভাসছে’ শিরোনামে ঢাকা পোস্টে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা হোয়াব্রাং এলাকার সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের সবগুলো নতুন ঘর পানিতে ভাসছে। ফলে সেখানে থাকা ২৭টি পরিবার দুর্ভোগে পড়েছে।
এ খবর প্রকাশিত হওয়ায় ক্ষিপ্ত হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি তার অফিসিয়াল নম্বর থেকে ঢাকা পোস্টের কক্সবাজার প্রতিনিধি সাইদুল ফরহাদকে ফোন করে ধমক দেন এবং গালাগালি করেন।
এই ফোনালাপের অডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরদিন কক্সবাজারের হিলডাউন সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদের উদ্যোগে কক্সবাজার প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ইউএনও কায়সার খসরু ঢাকা পোস্টের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধির কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান।
এ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়, উষ্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ও আপত্তিকর। কোনো ‘রং হেডেড’ ব্যক্তি ছাড়া এ ধরনের ভাষা কেউ ব্যবহার করতে পারেন না।
সমালোচনার জেরে পরে তাকে ওএসডি করা হয়।
ফুটবল ট্রফি ভেঙে সমালোচনার মুখে আরেক ইউএনও
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে আলীকদম উপজেলার ২ নম্বর চৈক্ষং ইউনিয়নের রেপারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে আবাসিক স্বাধীন যুব সমাজের উদ্যোগে জুনিয়র একাদশ বনাম রেপারপাড়া বাজার একাদশ ফুটবল টিমের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহরুবা ইসলাম।
খেলার সমাপনী বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষের সামনে পুরস্কারের ট্রফি দুটি ভেঙে ফেলেন তিনি। ট্রফি ভাঙার ভিডিও রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
সমালোচনার মুখে তিনদিন পর গত ২৬ সেপ্টেম্বর আলোচিত সেই ইউএনওকে ঢাকা বিভাগে বদলি করা হয়।
সরকারি তালিকায় এক অতিরিক্ত সচিবের ২৯ বই
সরকারি কর্মকর্তাদের ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস’ বাড়ানোর জন্য বই কিনতে ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এজন্য ১ হাজার ৪৭৭টি বইয়ের তালিকা দেওয়া হয়েছিল। তালিকায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামের ২৯টি বই রয়েছে- এমন খবর প্রকাশ করে একটি জাতীয় দৈনিক। প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরপরই আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে।
• আরও পড়ুন : সেই বইয়ের তালিকা বাতিল করল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
প্রশ্ন ওঠে বই বাছাইয়ের প্রক্রিয়া নিয়েও। একজন অতিরিক্ত সচিবেরই ২৯টি বই তালিকায় স্থান পাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল, সমালোচনার বন্যা বয়ে যায়। গত ২৯ আগস্ট বইয়ের তালিকাটি বাতিল করা হয়।
অন্যান্য অপরাধে শাস্তি
বিদায়ী বছর নানা অনিয়ম বা অপরাধের কারণে বিভাগীয় মামলায় শাস্তি পেয়েছেন প্রশাসনের বিভিন্নস্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। এরমধ্যে গত ২১ নভেম্বর মামলা তুলে নিতে হুমকি ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে উপসচিব এ কে এম রেজাউল করিমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে, এক নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে এবং ওই নারীর নামে ব্যাংকে হিসাব খুলে লেনদেনের দায়ে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সাবেক ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজকে বিদায়ী বছর বেতন গ্রেড কমানোর ‘লঘুদণ্ড’ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বর্তমানে তিনি এ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে আছেন।
যৌন হয়রানির দায়ে গত ১৩ অক্টোবর কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরের ইউএনও অমিত চক্রবর্ত্তী শাস্তি পেয়েছেন। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের ইউএনও থাকার সময় অমিত চক্রবর্ত্তীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে শাস্তি হিসেবে লঘুদণ্ড ‘তিরস্কার’ করা হয়েছে।
পদোন্নতি
বিদায়ী বছর প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বেশ কয়েকটি বড় পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনে উপসচিব পদে ১ অক্টোবর পদোন্নতি পান ২৫৯ জন কর্মকর্তা। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে তাদের এ পদে পদোন্নতি দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
গত ২ নভেম্বর যুগ্মসচিব পদে ১৭৫ জন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয় সরকার। এদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর আগে গত ২৯ জুন যুগ্মসচিব পদে ৮২ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে, এ বছরের ৬ এপ্রিল অতিরিক্ত সচিব পদে ৯৪ জন যুগ্মসচিবকে পদোন্নতি দেয় সরকার।
বিদায়ী বছর মাঠ প্রশাসনেও বড় ধরনের রদবদল আনা হয়। গত ২৩ নভেম্বর রাতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ জেলাসহ দেশের ২৩টি জেলায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে পরিবর্তন আনে সরকার। এরমধ্যে কয়েকটি জেলায় বদলির মাধ্যমে এবং বাকি জেলায় নতুন কর্মকর্তাদের ডিসি করা হয়।
সময় কমিয়ে নতুন নিয়মে অফিস
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গত ২৪ আগস্ট থেকে সময় কমিয়ে নতুন নিয়মে অফিস করেন সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা-কর্মচারীরা। নতুন নিয়মানুযায়ী সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সরকারি অফিস চলে। এতে কর্মঘণ্টা ১ ঘণ্টা কমে। শীত আসায় গত ১৫ নভেম্বর থেকে এ সময়সূচি ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নির্ধারণ করে সরকার। এতেও কর্মঘণ্টা ১ ঘণ্টা কম।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত চাকরিপ্রার্থীদের বয়সে ছাড়
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সে ৩৯ মাস ছাড় দেয় সরকার। গত ২২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এর আগে করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের জন্য দুই দফায় বয়স ছাড় করে আদেশ জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সে সময় মোট ২১ মাস বয়সের ছাড় দেওয়া হয়। তবে বয়সের এই ছাড় বিসিএসের জন্য প্রযোজ্য হয়নি।
এসএইচআর/এনএফ