বাংলাদেশে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হচ্ছে, আয় বাড়ছে কিন্তু তার মধ্যে অসমতা থাকায় সকল মানুষের কাছে উন্নয়নের ধারা সমানভাবে যাচ্ছে না।

বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত নাগরিক নাগরিক প্ল্যাটফর্মের মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বক্তাদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে আসে।

জাতীয় উন্নয়ন কতখানি সুষমভাবে স্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বোঝার জন্য নাগরিক প্ল্যাটফর্ম সম্প্রতি উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে সাতটি নাগরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করে। পরামর্শ সভাগুলো গত ৪ জুন রংপুরে, ২ জুলাই, খুলনায়, ৩১ জুলাইয়ে টাঙ্গাইল, ১৩ আগস্ট সিলেটে, ২৪ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে, ১ অক্টোবর রাঙ্গামাটিতে এবং ২ অক্টোবর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ২৫টি জেলার ৫০০ এরও বেশি নাগরিক এ সভায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
 
সভায় বক্তারা বলেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতি বছর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, আয়বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং কাঠমোগত বিভিন্ন পরিবর্তনের সমীক্ষা আমাদের সামনে বিদ্যমান। এছাড়াও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, ডিজিটাল সংযোগের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এমনকি কোভিড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ৭৫.২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর সব ডোজের টিকাদান সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি স্থানীয় বাস্তবতার চিত্র নীতির প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। 

প্রেস ব্রিফিংয়ের সভাপতিত্ব করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য পরামর্শ সভার সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। 

তার উপস্থাপনায় বলেন, বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবেই উন্নয়নের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই জাতীয় উন্নয়ন আলেখ্যের স্থানীয় ভিত্তিটা কতখানি মজবুত? বিশেষ করে যারা প্রথাগতভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ আছে তাদের ভূমিকা কতখানি? তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিনিধিদের সমস্যা অনুধাবনের মাধ্যমে তথ্য উন্মোচন করার লক্ষ্যে সাতটি অঞ্চলে নাগরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয় যেখান থেকে উঠে আসা তথ্যগুলো জাতীয় উন্নয়নকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করেন তিনি। যদিও বাংলাদেশে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হচ্ছে, আয় বাড়ছে কিন্তু তার মধ্যে অসমতা বিদ্যমান এবং সব মানুষের কাছে এ উন্নয়নের ধারা সমানভাবে যাচ্ছে না।

তিনি তার উপস্থাপনায় উপ-আঞ্চলিক নাগরিক পরামর্শ সভা থেকে উঠে আসা মোট ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করেন। প্রথমত তিনি বলেন, যুবসমাজের ক্ষেত্রে মানসম্মত কর্মসংস্থানের অভাবের কথা। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিও পিছিয়ে পড়া মানুষের জনজীবনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টিকে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, নারীদের অবদান সমাজে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও তাদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। অন্যদিকে, পরিবেশ দূষণের বিষয়টিকেও ড. দেবপ্রিয় জাতীয় সমস্যা বলে মন করেছেন।

এছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারি সেবার যথাপোযুক্ত মানের অভাব ও  সমাজে ভয়ের সংস্কৃতির সৃষ্টি করা কথা বলেছেন তিনি।

ড. দেবপ্রিয় তার উপস্থাপনায় খাতওয়ারি আলোচনা তুলে ধরেন, যেখানে তিনি পাঁচটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা বেড়েছে কিন্তু শিক্ষার গুণগত মানের পতন হচ্ছে। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে অনেকেই আর্থিক সঙ্গতির অভাবে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। যে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে তা দিয়ে সমগ্র শিক্ষার খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। 

অন্যদিকে, স্বাস্থ্যখাতে মানের উন্নয়ন হচ্ছে না। যদিও বড় বড় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হচ্ছে, হাসপাতাল হচ্ছে কিন্তু সেখানে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে না। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় সুপেয় পানির অভাব এবং পয়ঃনিষ্কাশনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। যা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। এছাড়াও সামাজিক সুরক্ষার পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়। 

স্থানীয় পর্যায় থেকে কর্মক্ষেত্রে বিষয়ে তিনটি পেশাজীবিদের কথা এসেছে বলে মন্তব্য করেন ড. দেবপ্রিয় বলেন, কৃষকদের অর্থনৈতিক ক্ষতি, সীমাবদ্ধ ব্যাংক ঋণ, বীজ ও পণ্যের বাজারে প্রবেশাধিকারে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে আদিবাসীরা বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা চাকরিক্ষেত্রে কোটা থাকা স্বত্বেও তারা চাকরি পাচ্ছে না। অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার মাসগুলোতে জেলেদের চাল বরাদ্দের অপ্রতুলতা, চা শ্রমিকদের মজুরি ও জীবিকার সমস্যা এবং অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগে সমস্যার কথাও উপস্থাপনায় উঠে আসে। 

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, আজকে তৃণমূলের বক্তব্য উপস্থাপন হয়েছে যেখানে দুটি বিষয় উঠে এসেছে। তা হলো বণ্টনের দিক এবং আকাঙ্ক্ষার দিক। উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে গড়ের সমীকরণ আমাদের সমাজে আছে সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এ গড়ের কাছাকাছি স্থানীয় মানুষদের তখনই আনা সম্ভব যদি ইতিবাচক বৈষম্যমূলক আলোচনা হয় এবং তা হতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। 

আর আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, দৃশ্যমান যে উন্নয়ন হয়েছে সেখানের দৃশ্যের সঙ্গে মানের ব্যাপারেও গুরুত্ব দিতে হবে। এ জায়গাগুলো অর্জনের জন্য তিনি সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নতুন সক্ষমতা তৈরির কথা বলেছেন। সবশেষে তিনি বলেন যে, তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। 

আরএম/এসএম