শারমিন আরা

শারমিন আরা। ডাক নাম শিমু। সবাই তাকে এ নামেই চেনে। কাজ করছেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের পার্সার অ্যান্ড কেবিন ক্রু ইন্সট্রাক্টর হিসেবে। খুলনার টুটপাড়া থেকে উঠে আসা মেয়ে শিমুর সঙ্গে নারী দিবস উপলক্ষে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি শোনান তার জীবনের উত্থানের গল্প। সাহসিকতা ও আত্মবিশ্বাসের গল্প।

শিক্ষকতার ইচ্ছা নিয়ে চাকরি জীবন শুরু করা শারমিন বর্তমানে আকাশে ওড়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের পার্সার অ্যান্ড কেবিন ক্রু ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। তার অধীনে শতাধিক কেবিন ক্রু প্রতি বছর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

‘ছোটবেলা থেকে অনেকে অনেক স্বপ্ন দেখে, পেশা বেছে নেয়। আমার সুনির্দিষ্ট করে তেমন কিছুই ছিল না। তবে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আমার একটু ফ্যাসিনেশন কাজ করত। মাঝে মাঝে আবার ইচ্ছা হতো শিক্ষক হওয়ার। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার।’ ঢাকা পোস্টকে বলছিলেন শারমিন আরা।

পরিবারের সঙ্গে শারমিন আরা

এরকম চ্যালেঞ্জিং সেক্টরের আসার কারণ হিসেবে শারমিন বলেন, আমার বাবা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। আমার বোন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে আছেন। শিক্ষকতার ইচ্ছা ছিল, আবার পোশাকের প্রতি একধরনের টানও ছিল। ছোটবেলা থেকেই ইউনিফর্মের সম্মানটা আমাকে খুব আকৃষ্ট করত। অন্য ৮/১০ জন যখন হেঁটে যায় একরকম সম্মান পায়, ইউনিফর্ম পরা ব্যক্তি আরও বেশি সম্মান পায়। অন্য সেক্টরেও যেতে পারতাম, তবে এই সেক্টরে আমার বোনসহ অনেককেই ছোটবেলা থেকে দেখছি। তাই এভিয়েশনে আসাকেই প্রাধান্য দিয়েছি।

পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ
শারমিন শিক্ষকতার পাশাপাশি কেবিন ক্রু হিসেবেও ফ্লাইট পরিচালনা করছেন। শারমিনের জন্ম খুলনার টুটপাড়ায়। তার শৈশবটা কেটেছে সেখানেই। স্থানীয় সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। দুই পরীক্ষায়ই আর্টস বা মানবিক বিভাগে পড়েছেন তিনি। উচ্চশিক্ষার জন্য ২০০২ সালে ঢাকায় আসেন শারমিন। লালমাটিয়া মহিলা কলেজে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হলেও সেসময় মাস্টার্স আর শেষ করতে পারেননি।

তিনি বলেন, ‘মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগেই ২০০৯ সালে এভিয়ানা এয়ারওয়েজ লিমিটেডের (রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্স) কেবিন ক্রু পদের একটি সার্কুলার হয়। আমার ভাই মিথুন আমাকে সার্কুলারটি দেখায়। আমার জীবনে এই ভাইয়ের অবদান অনেক বেশি। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। সার্কুলার পেয়ে আমি সেখানে আবেদন করি। আবেদনের পর তারা ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকে। পরে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। উত্তীর্ণ হওয়ার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমাকে কেবিন ক্রু হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ক্রু হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর আমাকে সেখানে আড়াই মাসের একটি গ্রাউন্ড ট্রেনিং দেওয়া হয়। ট্রেনিং শেষেই ফ্লাইটে পাঠানো হয়।’

শারমিন আরা

এভিয়ানাতে বছরখানেক চাকরি করার পর শারমিন ২০১০ সালে যোগদান করেন জিএমজি এয়ারলাইন্সে। সেখানে ‘ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট’ পদে কাজ শুরু করেন। দায়িত্বপালন করেছেন ড্যাশ-৮, বোয়িং ৭৬৭ বিমানে। তবে দুই বছর পর যখন জিএমজি এয়ারলাইন্স বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু শারমিন বসে থাকেননি। কয়েকদিনের মধ্যেই ‌‌‘সিনিয়র এক্সিকিউটিভ-অ্যাডমিন অ্যান্ড ফিন্যান্স’ হিসেবে যোগদান করেন ইউনিক এয়ারলাইন্স ট্রেনিং একাডেমিতে। 

প্রায় একবছর সেখানে চাকরির পর ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে কেবিন ক্রু হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে। বিমানের চুক্তি শেষে ২০১৪ সালের মার্চে ‘কেবিন ক্রু হিসেবে’ যোগ দেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে।

শারমিন বলেন, ‘ইউএস-বাংলায় যোগদানের আগে ও পরে সব মিলিয়ে যখন পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা হয়, তখন ২০১৮ সালে ইউএস-বাংলায় ইন্সট্রাক্টরশিপ বা প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পাই। তখন থেকেই কেবিন ক্রুদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। ২০১৮ সালের আগে আমি শুধুই কেবিন ক্রু ছিলাম। এখন ইন্সট্রাক্টর, পাশাপাশি কেবিন ক্রু হিসেবেও ফ্লাইটে থাকি।’

যা শেখান শারমিন
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে সাত বছর ধরে কর্মরত শারমিন। এখানে নিয়োগপ্রাপ্ত কেবিন ক্রুদের গ্রাউন্ড ও ইন-ফ্লাইট ট্রেনিং দেন তিনি। শারমিনের ভাষায়, ‘কেউ যখন কেবিন ক্রু হওয়ার জন্য আবেদন করেন, তখন মানবসম্পদ বিভাগ থেকে তাদের প্রাথমিক নির্বাচন ও লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলে তাদের ৮-১০ জন করে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে গ্রুপ-ডিসকাশনের আয়োজন করা হয়। সেখানে আবেদনকারীদের সমসাময়িক কোনো বিষয়ে ওপর আলোচনা করতে দেওয়া হয়। এ সময় কে জোরে কথা বলে, কে যৌক্তিক কথা বলছে, কে উত্তেজিত হচ্ছে, কে শান্ত থাকছে ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে নিয়োগ দেওয়া হয়।’

প্রশিক্ষক শারমিন আরা

‘নিয়োগের পর এভিয়েশনের ইতিহাস, চেকইন-ইমিগ্রেশনসহ বিমানবন্দরের বিভিন্ন প্রক্রিয়া, প্যাসেঞ্জার রিসিভিং ইত্যাদি নিয়ে মোট ১১টি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়াও একজন যাত্রীর কোনো আচরণে কীভাবে পরিস্থিতি সামলাতে হবে, কখন কোন কাজ করতে হবে পড়াশুনার মাধ্যমে এগুলো শেখাই আমি,’ যোগ করেন শারমিন।

শারমিন বলেন, ‘আমাদের প্রতিটা ফ্লাইট একেকটা চ্যালেঞ্জ। ফ্লাইটে অনেক যাত্রী থাকে। একেকজনের আচরণ-ভাবভঙ্গি একেকরকম। কেউ কেবিনে আলো জালিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করে, কেউ লাইট বন্ধ করে। এভাবে সবার সব চাহিদা পূরণ করা, নিজেদের নিরাপদ রেখে তাদের সামলানোর কৌশল শেখাই আমি।’

এছাড়াও ফ্লাইটে মেডিক্যাল ইমার্জেন্সির সময়ে কি করতে হবে, ফ্লাইটে যাত্রী অচেতন হলে, সেসময় কেবিন ক্রু কি করবে, ক্রুর সঙ্গে ক্রু এবং ক্রুর সঙ্গে যাত্রীদের যোগাযোগ কেমন হওয়া উচিৎ এ বিষয়গুলো হাতে-কলমে শেখান শারমিন।

দুর্যোগ পরিস্থিতিতে কেবিন সামলানোর অভিজ্ঞতা
একজন কেবিন ক্রুর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে অনেক সময় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ফ্লাইটে ঝাঁকুনি হয়। তখন অনেকেই প্যানিকড বা আতঙ্কিত হয়ে যায়। ওই পরিস্থিতিতে কেবিন সামলানোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে শারমিন বলেন,  ‘তখন সর্বোচ্চটা দিয়ে যাত্রীদের শান্ত রাখার চেষ্টা করি। এধরনের পরিস্থিতিতে প্রথমেই আমরা যাত্রীদের জন্য বিশেষ অ্যানাউন্সমেন্ট করি। আমরা যাত্রীদের সিট বেল্ট বেঁধে নিজ নিজ সিটে বসে থাকতে বলি। কেবিনের ভেতর থেকে আমরা বারবার উঁকি দিয়ে দেখি, সবাই ঠিক আছেন কি না? সবাই সিট বেল্ট পড়েছেন কি না।’

শারমিন বলেন, অনেকেই মনে করেন, কেবিন ক্রুর একমাত্র দায়িত্ব যাত্রীদের খাবার দেওয়া। এ ধারণা ঠিক নয়। লম্বা ফ্লাইটে যাত্রীদের খাওয়া দেওয়া অবশ্যই আমাদের দায়িত্ব। তবে আমাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে যাত্রীদের নিরাপদে রাখা। সেজন্য আমি ও অন্যান্য ক্রুরা বদ্ধ পরিকর। 

কেবিনের পাশাপাশি সংসারও সামলাচ্ছেন শারমিন
কর্মজীবন সামলানোর পাশাপাশি সাড়ে ৮ বছর ধরে সংসার জীবনও সামলাচ্ছেন শারমিন। তার স্বামীর নাম তৌহিদ। তিনি সেভ দ্যা চিলড্রেনে ম্যানেজার (হিউম্যানিটেরিয়ান) হিসেবে কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটাও খুব ভালো।

সংসার জীবন নিয়ে শারমিন বলেন, ‘আমার স্বামী নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে। আমাকে কর্মক্ষেত্রে ও সাংসারিক জীবনে সবধরনের সহযোগিতা করে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও আমার পেশা নিয়ে খুবই খুশি। তাদের সর্বোচ্চ সাপোর্ট পেয়েই আজ আমি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারছি।’ 

কর্মজীবনে ভালো লাগার একটি মুহূর্ত...
প্রশ্ন শুনেই উচ্ছ্বাসিত শারমিন বললেন, প্রতি ফ্লাইটেই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়, ভালো লাগার অনেক কিছুই থাকে। তবে ২০১৭ আমার সঙ্গে একটি ঘটনা ঘটেছিল, সেটি ভেবে এখনো আমি আপ্লুত হই। সে বছর আমার ফ্লাইটে একজন বৃদ্ধা নারী ছিলেন, তিনি ঠিক মতো হাঁটতে পারছিলেন না। তাকে আমি হাত ধরে প্লেনের সিড়ি দিয়ে গ্রাউন্ডে নামিয়ে এনেছিলাম। প্রায়ই আমরা এধরনের কাজ করে থাকি। তবে সেদিন ওই ফ্লাইটের কেউ বা অন্য কেউ (আমার জানা নেই) বৃদ্ধা নারীকে সিড়ি দিয়ে নামানোর ছবি তুলেছিল ও ইউএস-বাংলার এয়ারলাইন্সের কাছে পাঠিয়েছিল। সেটি দেখে নিজ কর্মক্ষেত্রসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক প্রশংসা পেয়েছিলাম। অনেক অনুপ্রেরণাও পেয়েছি। ওই বছর ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স থেকে আমি একটি বেস্ট সার্ভিস অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলাম।

এছাড়াও অনেক ফ্লাইটেই অসুস্থ যাত্রী থাকে। অনেকে আবার ফ্লাইটেই অচেতন হয়ে পড়েন। আমরা তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলি। ওই মুহূর্তগুলো খুব আনন্দের হয়।

পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা কেমন, বৈষম্যের শিকার হয়েছেন কি?
শারমিন বলেন, ‘আমি যখন জিএমজি এয়ারলাইন্সে ছিলাম তখন আমার তেমন কোনো পুরুষ সহকর্মী ছিল না। ক্রু হিসেবে অধিকাংশ মেয়েই ছিল। জিএমজি বন্ধের আগে কয়েকজন পুরুষ নিয়োগ দেয়। তবে তাদের সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা বেশ ভালো ছিল। আমি সিনিয়র ছিলাম, ওরা আমাকে খুবই সম্মান করত। তাদের সঙ্গে কখনোই কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝি হয়নি।

২০১৪’তে যখন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে যুক্ত হই, তখন জুনিয়র হিসেবেই জয়েন করেছিলাম। অধিকাংশই আমার সিনিয়র ছিলেন। তাদের কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। বৈষম্য কিংবা অবহেলা চোখে পড়েনি। আর এখন যারা আসছে তারা তো আমার স্টুডেন্ট, সব মিলিয়ে নারী হিসেবে এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো বৈষম্য লক্ষ্য করিনি।

‘জীবনে আগাতে হলে সাহসী হতে হবে, প্রতিবাদী হতে হবে’
সব শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষদের উদ্দেশ্যে শারমিন বলেন, ‘নারীত্ব মানে শুধু মাতৃত্ব নয়। নারী সত্তার পূর্ণ বিকশিত হয় নারীর স্বাধীনতার মাধ্যমে। নারীরা এখন আর অবলা নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে বেরিয়ে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠাই হল নারী দিবসের সার্থকতা।’

শারমিন বলেন, ‘শুধু ফ্লাইট নয় নারীদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই এক-একটি চ্যালেঞ্জ। তাই মেয়েদের প্রতিবাদী হতে হবে, সাহসী হতে হবে।’

এআর/ওএফ