কারাগারে জঙ্গিদের সেলে ছিল টিভি, কথা বলত মোবাইল ফোনে
ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রধান ফটকের সামনে থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল কয়েক মাস আগে। সহযোগীদের সঙ্গে জঙ্গিরা যোগাযোগ রাখত মোবাইল ফোনে। কাশিমপুর কারাগার থেকে জঙ্গিরা দীর্ঘদিন ধরে সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল। মোবাইল ফোন নিয়ে একবার কারারক্ষীর কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে জঙ্গিরা। সেটি জব্দ করা হয়। পরে আবারও তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করে।
বিজ্ঞাপন
গ্রেপ্তার আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, বিভিন্ন জনকে টাকা দিয়ে জঙ্গিরা কারাগারে মোবাইল ফোন ব্যবহার করত। এছাড়া জঙ্গিদের সেলে দীর্ঘদিন টেলিভিশনও ছিল। তারা নিয়মিত টেলিভিশন দেখত, সংবাদ দেখত। টাকার বিনিময়ে কারাগারে বসে জঙ্গিরা নিয়মিত এসব সুবিধা নিত।
আরও পড়ুন : জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার মিশনে অংশ নেয় ১৭-১৮ জন
এ বিষয়ে ডিএমপির সিটিটিসি প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কারাগারে জঙ্গিরা কীভাবে ছিল তা এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলো দেখছে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি বলতে পারবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গঠিত তদন্ত কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তারা সব বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করছেন। এরমধ্যে বেশকিছু তথ্যও তারা পেয়েছেন, যা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে।
আরও পড়ুন : ‘ধরা পড়েও’ না পড়া মেজর জিয়াই এখন বড় হুমকি
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সভাপতি ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এ কে এম হাফিজ আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সব বিষয়কে সামনে রেখে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করছি। তদন্ত প্রতিবেদনে সব বিষয় উঠে আসবে। তদন্ত শেষ করতে আর সময় লাগবে।
এদিকে আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পরিকল্পনা কারাগারে হয়েছে- এমন তথ্য সামনে আসার পর নড়েচড়ে বসেছে কর্তৃপক্ষ। এসব আলোচনার মধ্যে গতকাল (মঙ্গলবার) কারা অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বদলি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন : জঙ্গিদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত ঝুঁকি থেকেই যায়
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের এক বদলির আদেশে বলা হয়, চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক এ কে এম ফজলুল হককে ঢাকা বিভাগে, রংপুর কারা উপ-মহাপরিদর্শক মো. আলতাব হোসেনকে চট্টগ্রাম বিভাগে ও ঢাকা বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ তৌহিদুর হককে রংপুর বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
আরও বলা হয়, হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. আব্দুল আজিজকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালাকে হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
অন্যদিকে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, জঙ্গিদের কারাগারে হাই সিকিউরিটি সেলে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় রাখা হয়। তারপরও যদি কারাগারে বসে পরিকল্পনা করা ও জঙ্গিদের হাতে ফোন তুলে দেওয়ার ঘটনা প্রমাণিত হয় বা কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যদি প্রমাণিত হয় কারাগারে জঙ্গিরা বসে আদালত থেকে পালানোর পরিকল্পনা করেছে বা এই পরিকল্পনা করতে কারাগারের কেউ সহযোগিতা করেছে বা তাদের ফ্যাসিলিটেট করেছে তাহলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
উল্লেখ্য, গত ২০ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে দুই জঙ্গিকে একটি মামলায় আদালতে হাজির করা হয়। হাজিরা শেষে পুলিশ সদস্যরা তাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশের চোখে-মুখে স্প্রে করে জঙ্গি সদস্য মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এই দুই জঙ্গি দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে জঙ্গি আসামি ছিনতাইয়ের মাস্টারমাইন্ড হলেন নিষিদ্ধ-ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের প্রধান সমন্বয়ক মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। তার অনুমতিতে এই ছিনতাই অপারেশন পরিচালনা করেন সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান মশিউর রহমান ওরফে আইমান।
রিমান্ডে নেওয়া আসামিরা হলেন শাহীন আলম ওরফে কামাল, শাহ আলম ওরফে সালাউদ্দিন, বি এম মজিবুর রহমান, সুমন হোসেন পাটোয়ারী, আরাফাত রহমান, খাইরুল ইসলাম ওরফে সিফাত, মোজাম্মেল হোসেন, শেখ আব্দুল্লাহ, আ. সবুর, রশিদুন্নবী ভূঁইয়া।
গ্রেপ্তার থাকা জঙ্গি আরাফাত ও সবুরকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, কনডেম সেলে থাকা ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি আসামিরা প্রায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করতেন। কারাগারে বসেই পরিকল্পনা হয় আসামি ছিনতাইয়ের।
প্রথমে ত্রিশালের জঙ্গি ছিনতাইয়ের মতো প্রিজনভ্যানে হামলার করে সহযোগীদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে কাশিমপুর থেকে পুরান ঢাকায় আদালত পর্যন্ত আনা-নেওয়ার সময় প্রিজনভ্যানে হামলা করাটা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাদের।
তাই তুলনামূলক কম নিরাপত্তা থাকায় ছিনতাই অপারেশনের স্পট হিসেবে বেছে নেয় আদালত প্রাঙ্গণকে। আর অপারেশনের জঙ্গি সদস্যদের ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতে দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছিল সহযোগীরা।
জানা গেছে, ঘটনার পর তদন্তের অংশ হিসেবে পরদিন ২১ নভেম্বর সিটিটিসি একাধিক টিম কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার পরিদর্শনে যায়। প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে কারাগার থেকে কার মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে জঙ্গিরা বাইরে যোগাযোগ করেছিল তা জানার চেষ্টাও চলছে।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গি সদস্যকে ছিনতাই অপারেশনে নেতৃত্বদানকারীর নাম-পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এই অপারেশনে তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগীকেও শনাক্ত করা হয়েছে। জঙ্গি ছিনতাই অপারেশনে নেতৃত্বদানকারীসহ সবাইকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে আমরা কাজ করছি।
এমএসি/এআর/এসএম