‘ধরা পড়েও’ না পড়া মেজর জিয়াই এখন বড় হুমকি
আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দিনে-দুপুরে দুই জঙ্গি সদস্য ছিনতাইয়ের ঘটনায় আবারো আলোচনায় একাধিক হত্যার মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। যাকে গোয়েন্দা জালে ফেলে অনেকবার কাছে গিয়েও ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খাতায় ধূর্ত মেজর (বহিষ্কৃত) জিয়া মোস্ট ওয়ান্টেড। অভিজিৎ রায়, ফয়সাল আরেফিন দীপন ও জুলহাস-তনয় খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিলে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। বাংলাদেশ সরকার দেবে ২০ লাখ টাকা। তবে পুরোপুরি ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে চলা জিয়ার সঠিক অবস্থান অজানা।
বিজ্ঞাপন
কে এই মেজর জিয়া?
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা জসীমুদ্দিন রাহমানীকে গ্রেপ্তারের পর এবিটির শীর্ষ সংগঠক, সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার হওয়া মেজর জিয়াউল হকের নাম জানতে পারেন গোয়েন্দারা।
ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টায় ২০১২ সালে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া। অভ্যুত্থান চেষ্টায় জড়িত থাকায় দুই সেনা কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেও পালিয়ে যান জিয়া। এরপর তিনি যুক্ত হন জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে, পরে সেটির নামকরণ করেন আনসার আল ইসলাম।
জিয়ার পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঘটে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। আনসার আল ইসলামের বেশিরভাগ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হলেও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে তিনি। লেখক অভিজিৎ হত্যা, প্রকাশক দীপন ও রাজধানীর কলাবাগানে সমকামীদের অধিকার বিষয়ক কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যা মামলার রায়ে তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, প্রায় এক দশকে তারা অন্তত চারবার জিয়ার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় তার অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। তবে তাকে গ্রেপ্তারে বাহিনীর সদস্যরা পৌঁছানোর আগেই পালিয়ে যান তিনি।
আর এমন একজন জঙ্গিই নাকি ঢাকা মহানগর আদালত প্রাঙ্গণ থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছে বলে দাবি সিটিটিসি, ডিবি পুলিশ ও র্যাবের।
কিছুদিন আগেও জানা গিয়েছিল, মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি বহিষ্কৃত মেজর জিয়া নিজ গ্রাম মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে যান, এরপর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পুকুরে গোসল করেন, মাছও ধরেন। ঢাকাতেও এসেছিলেন টাকা তুলতে। এমন তথ্য পেয়ে ফাঁদ পেতেও ধরা যায়নি তাকে।
ডিএমপি’র কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তাদের ধারণা, মেজর জিয়া দেশেই আছেন। দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পাননি। ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে চলার কারণে তাকে ধরা যায়নি। আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি সদস্যসহ ছিনতাইয়ে অংশ নেওয়া ১০/১২ জন জঙ্গিও দেশেই আছেন। তাদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান, গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাচ্ছেন সিটিটিসি কর্মকর্তারা।
সিটিটিসি’র একাধিক কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, মেজর (বহিষ্কৃত) জিয়া গত বছর ঢাকার গুলিস্তানের আহাদ পুলিশ বক্সের পেছনে তার সংগঠনের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নিয়েছেন। সেই ব্যক্তিও জানতেন না, টাকা নিতে আসা ব্যক্তিই জিয়া। টাকা দেওয়া ওই ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও ধরা যায়নি জিয়াকে। ২০১৯ সালে ঈদুল ফিতরের আগে চট্টগ্রামে রেলের টিকিটও কাটেন তিনি। ঢাকার মোহাম্মদপুর ও বাড্ডায় থেকেছেন দীর্ঘদিন। টঙ্গিতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানেও হাজির হয়েছিলেন। ময়মনসিংহে আরেক জঙ্গির বাড়িতে ছিলেন কয়েক মাস।
তাহলে জিয়া এখন কোথায়?
আবারো আলোচনায় আসা মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটিটিসির ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাহমুদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা বলা খুব কঠিন। তিনি দেশে আছেন নাকি দেশের বাইরে আছেন সেটা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। তবে বিভিন্ন অ্যাকটিভিজ, তথ্য-উপাত্ত বলে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারেনি। ধারণা করা যায় দেশেই আছে। আমরা জানি আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান মেজর জিয়া। তিনি (জিয়া) সরব থাকতে যেভাবে অপারেশন হতো, এখনকার কর্মকাণ্ডের ধরণও একই রকম। সেক্ষেত্রে মনে হয় জঙ্গি ছিনতাইয়ের ডিরেকশনও একই। সেটা আমলে নিলে মেজর জিয়া দেশেই আছে অনুমান করা যায়।
এর আগে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, গোয়েন্দা তথ্য বলছে জঙ্গি জিয়া দেশেই আছেন। কয়েক দফা তাকে গ্রেপ্তারের খুব কাছাকাছি গেলেও শেষ পর্যন্ত ধরা যায়নি। এ ধরনের জঙ্গিরা ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে চলাফেরা করে বলেই ধরা কঠিন। সর্বশেষ গুলিস্তান থেকে দুই দফা নিজের সংগঠনের এক সদস্যের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন জিয়া। আরেক দফা নেওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী জালও ফেলেছিল পুলিশ। তবে সে জালে জড়ায়নি জিয়া।’
যে কারণে ধরা যাচ্ছে না জিয়াকে
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ক্যাডেট কলেজের মেধাবী ছাত্র জিয়া বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায়ও ছিলেন চৌকস কর্মকর্তা। নিজেকে রক্ষার সব কৌশলই তার জানা। প্রযুক্তি বিষয়েও ধারণা আছে। তাই তাকে আটকানো যাচ্ছে না।
এব্যাপারে জানতে চাইলে সিটিটিসির ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাহমুদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সে অনেক বেশি এক্সপার্ট, প্রশিক্ষিত। নিজেকে সুরক্ষার সব ধরনের কৌশলই তার জানা। চলাফেরা প্লানমাফিক। কাটআউট পদ্ধতিতে চলায় কৌশল, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টও পাওয়া কঠিন।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালের পর টানা অভিযানে গ্রেপ্তার অনেক জঙ্গি কারাগারে আছে। তারা জিয়ার চলাফেরা সম্পর্কে ধারণা রাখে, নির্দেশনাও বুঝত। কিন্তু তাদের অনেকেই তাকে কখনো দেখেনি। ছবি দেখানো হলে বলে দেখেছেন তাকে, কিন্তু জানতেন না তিনি সেই মেজর (বহিষ্কৃত) জিয়া।
জিয়া গ্রেপ্তার না হওয়া নিরাপত্তা হুমকি
জিয়া গ্রেপ্তার না হওয়া নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হিসেবে মন্তব্য করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, জিয়া অনেক ঘটনার মাস্টারমাইন্ড। তাকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত তো ঝুঁকি থেকেই যায়।
তিনি বলেন, পুলিশ যে সক্ষমতা নিয়ে যেভাবে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে সফল হয়েছে তা পৃথিবীতে অনন্য। কিন্তু এরপরও সাফল্যের মধ্যে ব্যর্থতার কালিমা রয়ে যায়। তারমধ্যে অন্যতম জিয়াকে গ্রেপ্তার করতে না পারা।
রোববার আদালতের সামনে থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় নিরাপত্তা পরিকল্পনায় ক্রটি ছিল দাবি করে তিনি বলেন, যেভাবে জঙ্গি আসামিকে হ্যান্ডেল করতে হয়, কারাগার থেকে আদালতে আনা নেওয়া করতে হয় সেখানে ব্যর্থতা, ত্রুটি তো ছিলই। আর কারাগার থেকেও আগাম তথ্য জানানো, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।
আরও বড় কোনো জঙ্গি হামলার আশঙ্কা মাথায় রাখা উচিত। সেটা শান্তিপূর্ণ কিংবা জঙ্গি তৎপরতার মধ্যেই হোক। যখন তখন সুযোগ পেলেই তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। আর যার মাস্টারমাইন্ড তাদের গ্রেপ্তার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে আরও বড় হামলার ঘটনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
গত রোববার (২০ নভেম্বর) চিফ জুডিশিয়াল আদালতের মূল ফটকের সামনে থেকে আনসার আল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় সংগঠনটির ১৭-১৮ জন সদস্য অংশ নেয়। ছিনিয়ে নেওয়ার মিশনে অংশ নেওয়া জঙ্গিদের মধ্যে ৫-৬ জঙ্গি মোটরসাইকেলে করে আসে। আর বাকি ১০-১২ জঙ্গি আদালতের আশপাশে অবস্থান নেয়। সম্পূর্ণ মিশনটি আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার (৪০) দিক নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় ঘটে।
ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি সদস্য হলেন-মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব। দুজনই দিপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। সাকিবুর অভিজিৎ হত্যা মামলারও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তাদের মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা অপর একটি মামলায় শুনানির জন্য আদালতে আনা হয়েছিল।
জেইউ/জেডএস