মো. ইমন, বাড়ি চট্টগ্রামে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বাবা থাকতেন। সেই সুবাদে তারও দুবাই আসা। এখানে এসে ফলের বাজারে কাজ করার ভিসা সংগ্রহ করেন। এখন তার মাসিক আয় বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭০ হাজার।

বাংলাদেশের মতো আরাম-আয়েশের জীবন নয় দুবাইয়ে, প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। থাকা-খাওয়া-ঘুম কোনোটাই হয় না ঠিকমতো। তবুও মানিয়ে নিয়েছেন ইমন। আক্ষেপ থাকলেও নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণি পাস করা ছাত্রকে বাংলাদেশে কেউ ৭০ হাজার টাকার চাকরি দেবে? তাই কষ্ট হোক আর যাই হোক, এখানেই থাকতে চাই।’

দুবাই শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে আল-আওয়ির ফ্রুট অ্যান্ড ভেজিটেবল মার্কেট। এ মার্কেটের অধিকাংশ ব্যবসায়ীই বাংলাদেশি। এমনকি মার্কেটের ট্রলিম্যান (কুলি), ঝাড়ুদার, ক্লিনারও বাংলাদেশি। তাদের কাছে এটি আবির ফ্রুট মার্কেট হিসেবেই বেশি পরিচিত।

আরও পড়ুন >> দুবাইয়ে বাংলাদেশি তরুণীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করছেন যারা 

আবির ফ্রুট মার্কেটে ট্রলিম্যানের (কুলি) কাজ করেন মো. ইমন। বয়স ২৪ বছর। এ মার্কেটেই ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় তার। জানান, বাবা দুবাইয়ের একটি মার্কেটে ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ করতেন। কাজ না থাকায় দুই মাস আগে তিনি বাংলাদেশে ফিরে গেছেন। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। বড় দুই ভাই ও দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। সবচেয়ে ছোট ভাই স্কুলে পড়ছে। বাবা দেশে চলে যাওয়ায় পুরো পরিবারের ভার এখন তার ঘাড়ে।

ট্রলি হাতেও খুশি তারা, কারণ ন্যায্য শ্রমের মূল্য মেলে এখানে | ছবি- ঢাকা পোস্ট

চট্টগ্রামের ইমন দুবাই আসেন ২০১৮ সালে। ট্যুরিস্ট ভিসায় এখানে আসা। পরে ৩৫ হাজার দিরহাম (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় নয় লাখ টাকা) দিয়ে এ মার্কেটে কাজ করার ভিসা নেন। এখন তিনি আবির মার্কেটের ট্রলিম্যান। কেউ কেনাকাটা করতে আসলে তার সঙ্গে দোকানে দোকানে ঘোরেন। তাদের কেনা ফল ও সবজি ট্রলিতে তোলা এবং গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়াই ইমনের কাজ।

একজন কাস্টমারের সঙ্গে ১০ থেকে ৪৫ মিনিট ঘোরাঘুরি করে সর্বনিম্ন ১০ দিরহাম (২৫০ টাকা) পান। কেউ আবার খুশি হয়ে ২০ থেকে ২৫ দিরহামও দেন। এভাবে দিনে ১০০ দিরহাম, মাসে অন্তত তিন হাজার দিরহাম (৭৫ হাজার টাকা) আয় হয় তার।

আরও পড়ুন >> স্বপ্নের দুবাইয়ে দুঃস্বপ্নের রাত পার করছেন বাংলাদেশি তরুণীরা 

স্থানীয় বনেদিয়া ক্যাম্পে থাকেন ইমন। সেখানে গাদাগাদি করে একটি কক্ষে ১০ জন থাকেন। থাকা-খাওয়া মিলে মাসে ৬০০ দিরহাম খরচ হয়। বাকি টাকা বাংলাদেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন।

ইমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্কুলশিক্ষক একবার ভুল বুঝে আমাকে মেরেছিল। সবার সামনে অপমান করেছিল। এরপর আর স্কুলে যাইনি। এখন এখানে আছি, কাজ করে খাচ্ছি, খারাপ নেই।’

এখানে মাসে ৭০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে, দেশে কে দেবে— প্রশ্ন ইমনের | ছবি ঢাকা পোস্ট

দুবাই আসার পথটাও সহজ ছিল না ইমনের জন্য। দরকার ছিল প্রায় আট লাখ টাকার। গ্রামের একটি এনজিও থেকে চার লাখ টাকা ঋণ নেন। বাকি চার লাখ টাকা বড় ভাই ও বোনজামাই থেকে নেন। এখানে (দুবাই) এসে প্রথম বছর দিন-রাত এক করে কাজ করেন। তখন প্রতি মাসে ঋণের সুদ-আসল মিলিয়ে মোট ৪৩ হাজার টাকা আর পরিবারের জন্য ১৫ হাজার টাকা পাঠাতেন ইমন।

আরও পড়ুন >> টাকায় অফলোড সিলও মুছে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ 

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে আপ্লুত ইমন বলেন, ‘প্রবাসে এসেছিলাম ভালো একটা সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু সেটা দুঃস্বপ্নই থেকে গেল। ভালো দিন বলতে কিছু নেই এখন। অভাবের সংসার। দেশে মা-বাবাকে খাওয়াতে হয়, ভাইকে খাওয়াতে হয়। কবে তাদের টাকা পাঠাব, সবসময় সেই টেনশনে থাকি। তবে এটা ঠিক এই বয়সে, এই যোগ্যতায় এতগুলো টাকা আয় করছি। বাংলাদেশে কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।’

‘পরের চাকরি, লাথি-উষ্ঠা খেতে হয়। ভোর ৫টায় আসতে হয়, রাত ১২টায় যেতে হয়। তাহলে খাই কখন, ঘুমাই কখন’— যোগ করেন ইমন।

ইমনের সঙ্গে ট্রলিম্যানের কাজ করেন ফেনীর নাসির। তিন বছর আগে তিনিও দুবাই আসেন। বাবা কৃষক। প্রতিদিন অন্যের ক্ষেতে কাজ করে কোনোদিন ৪০০ টাকা, কোনোদিন ৫০০ টাকা আয় করেন। অভাবের সংসারে পড়াশোনা করতে না পারায় বাধ্য হয়ে দুবাই আসেন।

আরও পড়ুন >> জীবিত থাকলে রেমিট্যান্স যোদ্ধা, মারা গেলে বেওয়ারিশ 

নাসির ঢাকা পোস্টকে জানান, বাংলাদেশে শিক্ষার অনেক দাম। পড়াশোনা ছাড়া কেউ চাকরি দেয় না। কেউ ভালো চোখে দেখে না। ভালো বেতন পাওয়া যায় না। সারাজীবন মানুষের শোষণে থাকতে হয়। এখানে আমরা যারা আছি, শিক্ষাগত যোগ্যতা নাও থাকতে পারে। তবে, কাজের দক্ষতায় আল্লাহর রহমতে অনেক টাকা আয় করছি। বাংলাদেশে থাকলে হয়তো আমাকেও বাবার মতো ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে হতো। সারাদিন শ্রম দিয়ে ৫০০ টাকা আয় হতো। কিন্তু এখানে মাসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। কষ্ট হলেও এখানে বেশ ভালো আছি।

এআর/এসএসএইচ/এমএআর/