লেখক মুশতাক আহমেদ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হয়ে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর আগে তার শরীরের রক্তচাপ ৪৫-এর নিচে নেমে গিয়েছিল। রক্তচাপ কমে যাওয়ায় তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

গত বছরের ৬ মে মুশতাককে লালমাটিয়ার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হলে সেখানেও তাকে আসামি করা হয়। গ্রেফতারের পর গত দশ মাসে কয়েকবার আবেদন করেও জামিন মেলেনি এ লেখকের। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ৫৩ বছর বয়সী মুশতাক

তার মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সমালোচনার মুখে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও কারা অধিদফতরের পক্ষ থেকে আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি শিকদারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব আরিফ আহমদকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। সদস্য হিসেবে ছিলেন- অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (গাজীপুর) আবুল কালাম, কারা উপমহাপরিদর্শক (ময়মনসিংহ) মো. জাহাঙ্গীর কবির ও গাজীপুর জেলা কারাগারের সহকারী সার্জন ডা. কামরুন নাহার। কমিটিকে চার কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।

কমিটির কার্যবিধিতে বলা হয়, ‘উল্লিখিত (মুশতাক আহমেদ) হাজতি বন্দির মৃত্যুতে কারা কর্তৃপক্ষের কোনো প্রকার গাফিলতি ছিল কি না; যদি থাকে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা।’

‘এ বন্দি কারাগারের আসার পর তার কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যার বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ অবহিত ছিলেন কি না; যদি থাকেন সে বিষয়ে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি না; যদি না হয়ে থাকে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা।’

বুধবার (৩ মার্চ) দুই কমিটির প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে। বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মুশতাক আহমেদ গত বছরের ৬ মে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলায় কারাগারে অন্তরীণ হন। তিনি কারাগারে ইন্তেকাল করেন। প্রশ্ন আসছে তিনি কারাগারে কীভাবে মৃত্যুবরণ করলেন। আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছিলাম। গাজীপুরের ডিসি, তিনিও একটি কমিটি করেছিলেন। আইজি প্রিজন, তিনিও তাৎক্ষণিকভাবে একটি কমিটি করেছিলেন। সব কমিটির অভিমত একরকম। ভিডিও ফুটেজ ও কারাগারে যারা তার সঙ্গে অন্তরীণ ছিলেন, তার রুমে যে কয়জন ছিলেন, কর্তব্যরত চিকিৎসক যারা ছিলেন, হাসপাতালে যখন নিয়ে গেছেন, তাদের সবার অভিমত নিয়ে তারা যে রিপোর্ট (প্রতিবেদন) দিয়েছেন, সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যু মানে অস্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সেটাই তারা তাদের তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন। আমরা সব রিপোর্টেই এখন পর্যন্ত এটুকুই পেয়েছি। 

‘আমরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আরও বিস্তারিত জানতে পারব। এ পর্যন্ত আমাদের কাছে যা এসেছে, তাতে বুঝা যাচ্ছে এর মূল হলো এটা স্বাভাবিক মৃত্যু। তিনি বাথরুমে গিয়েছিলেন। বাথরুমে যাওয়ার পর সেখানেই তিনি অজ্ঞান হয়েছিলেন। তারপর তাকে কারাগারে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

সুরতহাল প্রতিবেদনেও মুশতাকের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে জানান আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এলেই আমরা চূড়ান্তভাবে জানতে পারব। প্রাথমিকভাবে ডাক্তাররা যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সেটাই আমাদের রিপোর্টে এসেছে; সেটাই আমি আপনাদের জানালাম।

জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দেশের কারাগারগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া; ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণগুলোর পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা; কারাগারের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া; নারী কারাগারে নারী ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া।

এছাড়া কারাগারের জনবল কাঠামো অনুযায়ী প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ নিশ্চিত করতেও তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।

মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর বিচার চেয়ে বের হওয়া মশাল মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জ

এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তার মৃত্যুর বিষয়টিকে ‘রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড’ বলে উল্লেখ করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। তারা মুশতাকের মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগে আন্দোলনও করেছে। আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের অন্তত ১৫ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এছাড়া তিন জনকে আটক করা হয়েছে। এদিকে কারাগারে মুশতাকের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

লেখক মুশতাকের মৃত্যু নিয়ে যখন নানা মহলে সমালোচনা হচ্ছে সে সময় আবারও জামিনের বিষয়টি সামনে আসে। একই মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর সোমবার (১ মার্চ) হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ৩ মার্চ কার্টুনিস্ট কিশোরকে ছয় মাসের জামিন দেন হাইকোর্ট। গ্রেফতারের ১০ মাস পর বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ থেকে মুক্তি পান ‍তিনি।

এসএইচআর/এসএসএইচ/এমএমজে