পিরোজপুরের যুবক মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিউল্লা অনেকদিন ধরে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। সেই স্বপ্নকে ব্যবহার করে তাকে ইউরোপে পাঠানোর প্রস্তাব দেন বাদশা। মোট ১৩ লাখ টাকার চুক্তিতে গত ৪ অক্টোবর ঢাকা থেকে দুবাই পাঠানো হয় শফিকুলকে। সেখানে আরও ২০ বাংলাদেশির সঙ্গে তাকে একটি বাসায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে সিরিয়া হয়ে লিবিয়ায় নেওয়া হয়। তারপর লিবিয়ার একটি বিমানবন্দরের পাশে বন্দি করা হয়।

এরপর শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নির্যাতনের কথা পরিবারকে জানিয়ে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী একেকজনের কাছ থেকে ১০-১২ লাখ থেকে শুরু করে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।

নির্যাতনের শিকার শফিকুল বলেন, জিম্মি করার পর পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে তারা। বড় ভাইকে জানানোর পর তিনি অনেক চেষ্টা করেও টাকা সংগ্রহে ব্যর্থ হন। পরে ভাই তেজগাঁও ডিবি পুলিশকে বিষয়টি জানান। এরপর গত ২৭ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা করেন তিনি।

সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের দেশীয় দুই সদস্য বাদশা ও রাজিব মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে লিবিয়ায় অবস্থান করা সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য সুলতানের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্যাতনের শিকার সফিকুল ইসলামকে লিবিয়া থেকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় ডিবি।

আরও পড়ুন : কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশিদের ‘সাইবার দাস’ বানাচ্ছে বাংলাদেশিরাই!

গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, ইউরোপে যেতে উদগ্রীব তরুণ যুবকদের টার্গেট করে ফাঁদ পাতে দেশে ও লিবিয়ায় অবস্থানকারী চক্রের সদস্যরা। তাদের মাধ্যমে অনেককে অবৈধভাবে দুবাই থেকে নৌ ও সড়ক পথ পাড়ি দিয়ে লিবিয়ায় নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।

মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ইউরোপে পাঠানোর নাম করে দুবাইয়ে নেওয়ার পর ডলার, পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে অবৈধ পথে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করা হচ্ছে বাংলাদেশিদের। শফিকুল ইসলামকেও এভাবে ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করা হয়। তার পরিবারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মানবপাচার চক্রের দুই সদস্যকে আমরা গ্রেপ্তার করি। এরপর লিবিয়া থেকে অপহৃত শফিকুলকে ফিরিয়ে আনি।

হারুন বলেন, গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বাদশা (৩১) ও রাজিব মোল্লা (৩৫) নামে মানব পাচার চক্রের দুই সদস্যকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে মানব পাচারকারী চক্রে জড়িত আরও অনেকের নাম জেনেছি। তাদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।  চেষ্টা অব্যাহত 

তিনি জানান, সারা দেশে অনেক থানাতেই মানব পাচারের অভিযোগে মামলা হচ্ছে। অনেক তরুণ-যুবক ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তিতে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেতে অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করে। তাদের অনেককে দুবাই নিয়ে জিম্মি করা হয়।

ভিকটিম সফিকুল ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে হারুন অর রশিদ জানান, গ্রেপ্তারকৃত বাদশা তাকে ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে গত ৪ অক্টোবর ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে দুবাই পাঠায়। সেখানে রাজিবের আত্মীয় সবুজ এয়ারপোর্টে শফিকুলসহ আরও ২০ জনকে রিসিভ করে একটি বাসায় নিয়ে যায়।

এরপর দুবাই থেকে সিরিয়া হয়ে লিবিয়ার মিসরাত এলাকার একটি ক্যাম্পে আটকে রাখে তাদের। সেখানে বাদশা ও রাজিবের বোন জামাই গাইবান্ধার সুলতানের নেতৃত্বে ভিকটিমকে আটকে রেখে নির্যাতন করে। মোবাইল ফোনে তার পরিবারকে কান্না শুনিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে।

ডিবি প্রধান বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা আন্তঃদেশীয় সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের সদস্য। বাদশা ও রাজিব দেশের বেকার যুবক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকদের ইতালি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় পাচার করে। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেকে এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ মারা গেছেন। কেউ এখনো টাকা দিতে না পারায় নির্যাতিত হচ্ছেন, বন্দি জীবনযাপন করছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, দেশের বাইরে যারা মানব পাচারে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব নয়। যেহেতু মামলা হয়েছে, আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেব। পাশাপাশি দেশ থেকে যাতে কেউ ইউরোপ পাঠানোর স্বপ্ন দেখাতে না পারে সেজন্য দেশে অবস্থান করা মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

ডিএমপির এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, প্রলোভন ও চক্রের খপ্পরে পড়ে তরুণরা জিম্মি হচ্ছে লিবিয়ায়, তাদের পরিবারগুলো নিঃস্ব হচ্ছে। তাই যথাযথ প্রক্রিয়ায় বৈধভাবে অনুমোদিত ও স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইউরোপে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী শফিকুল বলেন, দুবাই যাওয়ার পর বুঝতে পারি, আমি একা নই, আরও অনেক বাংলাদেশিকে তারা এখানে আনার পর জিম্মি করেছে। লিবিয়ায় নেওয়ার পর ভয়ানক নির্যাতন নেমে আসে আমাদের ওপর। অথচ দেশে থাকতেই সাত লাখ টাকা দিয়েছিলাম। কথা ছিল ইতালিতে চাকরি হওয়ার পর বাকি পাঁচ লাখ টাকা নেবে। কিন্তু তারা ইতালি তো দূরের কথা লিবিয়ায় নিয়েই আমাদের বন্দি করে। তারপর নির্যাতন করে টাকা আদায় করে।

জেইউ/এসএসএইচ