পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছেন, সিসা মানবদেহের জন্য একটি নীরব ঘাতক। যা পুরো শরীরের সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। সিসার স্নায়ুবিক বিষাক্ততা ছোট বাচ্চাদের বিকাশমান দেহ এবং মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করে। ক্ষতিকর সিসার দূষণ থেকে শিশু ও নারীসহ সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে।

মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) বিকেলে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের আয়োজনে ‌‘লিড পয়জনিং ইন বাংলাদেশ : রিসার্চ এভিডেন্স ফর আর্জেন্ট অ্যাকশন’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

এর আগে সেমিনারে ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত বাংলাদেশের সাড়ে তিন কোটি শিশু। লিড অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিং, টার্মারিক ও রং কারখানা এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্য পেন্সিল, কালি, খেলনা বা গহনাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে ব্যবহৃত সিসা থেকে ছড়াচ্ছে এ বিষক্রিয়া।

গবেষণা বলছে, বড়দের তুলনায় শিশুদের শরীরে সিসার প্রভাব বেশি। শিশুদের রক্তে সিসা মিশে গিয়ে সারা জীবনের জন্য স্নায়ুবিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। মস্তিষ্ক আক্রান্ত হচ্ছে, স্মরণশক্তি কমছে, অনেক ক্ষেত্রে কোমায় চলে যাচ্ছে শিশুরা।

আরও পড়ুন : সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত দেশের সাড়ে তিন কোটি শিশু

সিসার বিষক্রিয়া ঠেকাতে সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, সিসা দূষণ থেকে মানুষকে বাঁচাতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রায়ই অবৈধ ব্যাটারি উৎপাদন এবং পুনর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করছে। শুধু আইন প্রয়োগই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে পারে না বরং আমাদের ব্যাপক সচেতনতা প্রয়োজন। 

মন্ত্রী বলেন, সিসা দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সুশীল সমাজ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

পরিবেশমন্ত্রী বলেন, সরকারি উদ্যোগের ফলে যানবাহনে সিসা মুক্ত জ্বালানি ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের প্রায় ৮৫ শতাংশ‍ই সিসাই সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। পেইন্ট ও মশলায় সিসাও আমাদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। 

মন্ত্রী বলেন, সরকার প্রথমে ২০০৬ সালে এবং আবার ২০২১ সালে এসআরও জারি করে। এসআরওতে সিসা অ্যাসিড ব্যাটারির নিরাপদ ব্যবস্থাপনা জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ, পরিবেশগতভাবে নিরাপদ রিসাইক্লিং, ব্যাটারি ব্রেকার, ডিস্ট্রিবিউটর, ডিলার, আমদানিকারকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, কর্মীদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো সমাধান করা এবং রিপোর্টিং সিস্টেমের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলমের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, এটা খুবই পরিষ্কার সিসা বাংলাদেশের জন্য, শিশুদের জন্য কতোটা ক্ষতিকর। এটা প্রতিরোধযোগ্য, কিন্তু দিনদিন বাড়ছে।

তিনি বলেন, সিসা পলুশন বা পয়জনিং খুবই উদ্বেগের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। ইউনিসেফ এটা নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছে। কেন বাড়ছে কোথায় বেশি পয়জনিং হচ্ছে তা আমরা উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে বাংলাদেশ। সিসার ক্ষেত্রটা আরও বেশি উদ্বেগজনক। এখানে সিসা প্রতিরোধে পলিসি নির্ধারণের পাশাপাশি মনিটরিং ও ইনভেস্ট করা জরুরি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ডা. শামস এল আরিফীন বলেন, শিশুদের মধ্যে সিসার বিষক্রিয়া আর চলতে দেওয়া যায় না।  

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে ১০০ ভাগ শিশুর শরীরে সিসা পাওয়া গেছে। আর এক ঘণ্টাও বসে থাকা আমাদের জন্য বিপজ্জনক। আমাদের এখনই কাজ শুরু করতে হবে। ছোট ছোট বাচ্চারা ভিকটিম। অথচ ওরা জানে না ওদের কোনো দোষ নেই।  

তিনি বলেন, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয় কিন্তু ভিকটিম। কিন্তু সিসার ক্ষেত্রে আমরা কী করছি! শিশুদের ধ্বংস করে দিচ্ছি। ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। এখানে পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পলিসি লেভেলে কাজ করতে হবে। ফরমালিনের ক্ষেত্রে পলিসি হয়েছে, রেস্ট্রিক্ট করা হয়েছে। সময় এসেছে সিসাকে রেস্ট্রিক্ট করা, নিয়ন্ত্রণ করা। 

জেইউ/এসকেডি