ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন। দীর্ঘদিন ওয়াসার বিভিন্ন পদে চাকরি করে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসরে যান। তারপরও থেমে যাননি তিনি। মোটা অংকের বেতনের বিনিময়ে ওয়াসারই কনসালটেন্ট হয়ে যান। দুই বছরের মাথায় এমডি তাকসিমের আশীর্বাদে চুক্তিভিত্তিক পরিচালক (কারিগরি) হয়ে ওয়াসায় ফিরে আসেন।

অথচ ঢাকা ওয়াসার অর্গানোগ্রামে কোথাও এমন পদের অস্তিত্ব নেই। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সহিদ উদ্দিনকে অর্গানোগ্রাম ও বিধির বাইরে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করেও নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়। সেই পরিচালক থেকে এখন ডিএমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে ছুটিতে যাওয়া এমডি তাকসিমের অনুপস্থিতিতে এমডি হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করছেন তিনি।

বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সহিদ উদ্দিনকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে বুধবার (১৯ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সংস্থাটির অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্ব একটি টিম জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুদক তার কাছ থেকে যথাযথ জবাব পায়নি বলে জানা গেছে।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জানতে চাইলে ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সহিদ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়োগ ও পদোন্নতি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ দিয়েছে। আমি নিজে কিছু নিই নাই। কে অভিযোগ দিয়েছে আমার জানা নেই। আমি আসলে দুর্নীতি দেখি না।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি কোনো দুর্নীতি দেখি না, আসলে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি প্রকল্পে কনসালটেন্ট থাকে। তারাই দেখাশোনা করেন। তাদের দায়িত্ব প্রকল্পের কাজ শেষ করা। তাদের সুপারিশেই ঠিকাদারকে বিল দেওয়া হয়। এর বাইরে এক টাকাও দেওয়া হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদে যা যা জানতে চাওয়া হয়েছে, দুদক কর্মকর্তাকে তা বলেছি।

আরও পড়ুন : ‘দুর্নীতি দেখি না, দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই’

এ বিষয়ে ওয়াসা ও দুদকের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম সহিদ উদ্দিন ২০১৬ সালে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার পরপরই ওয়াসার কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। মাসে দেড় লাখ টাকা বেতনে এক বছর চার মাস কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন সহিদ উদ্দিন। এখানেই শেষ নয়। ২০১৮ সালের এপ্রিলে দুই বছরের চুক্তিতে পরিচালক (কারিগরি) হিসেবে নিয়োগ দেন এমডি তাকসিম এ খান। অথচ ঢাকা ওয়াসার অর্গানোগ্রামে এরকম কোনো পদ নেই। মন্ত্রণালয় কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। এরপর ধাপে ধাপে পদোন্নতি দিয়ে ডিএমডি বানানো হয় সহিদ উদ্দিনকে।

শুধু কি তাই, অর্গানোগ্রামের বাইরে অবৈধভাবে পদ সৃষ্টি করার অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে পরিচালক (কারিগরি) হিসেবে নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। নিয়োগ পাওয়ার চার মাস পর মন্ত্রণালয় থেকে এমন নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বেতন-ভাতা বন্ধ করে দাপ্তরিক সব কার্যক্রম থেকে বিরত রাখারও আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ওই আদেশে ১৯৯৬ সালের পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন এবং পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা/কর্মচারী) চাকরির প্রবিধানমালা-২০১০ এর সংশ্লিষ্ট ধারা পরিপন্থি ও বিধিসম্মত না হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় বলে জানা গেছে।

একই অভিযোগে বুধবার ঢাকা ওয়াসার কো-অর্ডিনেশন অফিসার শেখ এনায়েত আবদুল্লাহকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলীসহ চার কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা রয়েছে। এর আগে গত ১৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলীসহ সাত কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিল দুদক। তলব করা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ও পদোন্নতি সুবিধা নিয়েছেন।

এ বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, ওয়াসার কর্মকর্তা মো. আবুল কাশেম, এ কে এম সহিদ উদ্দিন, মৌসুমি খানম, ডেপুটি চিফ ফাইন্যান্স অফিসার রত্নদ্বীপ বর্মণ ও শেখ এনায়েত আবদুল্লাহ অবৈধভাবে নিয়োগ পান। পরে শেখ এনায়েত আবদুল্লাহ, প্রধান প্রকৌশলী মো. কামরুল হাসান ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান নিয়ম বহির্ভূতভাবে পদোন্নতি পান।

এর আগে, তিনটি ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ৬ প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র তলব করে চিঠি দেয় দুদক। তলব করা নথিপত্র আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে সরবরাহের অনুরোধ করা হয়। কিছু নথিপত্র ইতোমধ্যে দুদকে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ১৩২ কোটি ৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টাকা ছয়টি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের প্রত্যক্ষ মদদে ও নির্দেশে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে— এমন অভিযোগে তাকসিম এ খানসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন জমা পড়ে। পরে দুদকের এখতিয়ার বলে আদালত রায় দেয়। ওই আবেদনের সূত্র ধরেই দুদকে আরও একটি অনুসন্ধান শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে ওয়াসার পদ্মা জশলদিয়া প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, গন্ধবপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পে ১ হাজার কোটি টাকা, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে ১ হাজার কোটি টাকা, গুলশান বারিধারা লেক দূষণ প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকার দুর্নীতিসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগ পান প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। এরপর ধাপে ধাপে সময় বাড়িয়ে তিনি এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। বিতর্কিত তাকসিম এ খানের পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিধি মানা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো, ঠিকাদার নিয়োগে সিন্ডিকেট, ঘুষ লেনদেন, পদ সৃষ্টি করে পছন্দের লোক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অপছন্দের লোককে ওএসডি করাসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে।

আরএম/এসএসএইচ