আছে সরকারি পদ, চলে দালালিও
সড়কে স্বজন হারাননি এমন মানুষ এ দেশে বিরল। সড়কে মৃত্যুর মিছিলের নানা কারণের মধ্যে অদক্ষ চালক অন্যতম। এক জন অদক্ষ চালককে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া নিরক্ষরকে এমবিবিএসের সনদ দেওয়ার মতোই আত্মঘাতী! অথচ আত্মঘাতী এই কাজ প্রতিনিয়ত হচ্ছে কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে। এই কাজে সহায়তা করছেন খোদ পুলিশ ও আনসার সদস্যরা।
এখানেই শেষ নয়, চমক আরও বাকি। রক্ষকই যখন ভক্ষক, নীতি আর আদর্শ যখন জাদুঘরে, তখন ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষার আগে সামান্য কিছু টাকা দেবেন! ব্যাস, পরীক্ষায় বসলেই পাস।
বিজ্ঞাপন
পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে দালাল হিসেবে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে আনসার ও পুলিশ সদস্য ছাড়াও আছে স্থানীয় প্রভাবশালী আর বিআরটিএ কর্মকর্তাদের আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতরা। ভোগান্তি এড়াতে সেবাপ্রত্যাশীরা ধরছেন এসব দালাল। আর দালালরা ভাগের টাকাটা পৌঁছে দিচ্ছে কর্মকর্তাদের ঘরে। ফলে দালাল না ধরে এখানে সেবা পাওয়া এক অপ্রত্যাশিত ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
এই দালাল চক্রের দুই সদস্য আরিফ ও নবী। পেশায় ফুলটাইম আনসার, পার্টটাইম দালাল তারা। কার্যালয়ের গেট দিয়ে ঢুকতে নিজের পরিচয় গোপন রেখে তথ্যকেন্দ্রের সামনে এসে দাঁড়ালে ঢাকা পোস্ট-এর এই প্রতিবেদকের কাছে তারা জানতে চান, ‘কী করবেন? ড্রাইভিং না রেজিস্ট্রেশন?’
‘কাগজপত্র কিছু এনেছেন? এনআইডি আর ছবি হলেই হবে। নগদ লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স নিলে পাবেন সুলভে। ডিসকাউন্ট অফার মাত্র এক হাজার ২০০ টাকা। ৬০০ লাগবে ব্যাংক ড্রাফটের জন্য। বাকিটা আমাদের সার্ভিস চার্জ।’
বিআরটিএর লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফি ৫১৮ টাকা। তা এক হাজার ২০০ টাকার ডিসকাউন্টে পাওয়ার অফার শুনে ঢাকা পোস্ট প্রতিবেদক বলেন, ‘বড় ভাই আসছে, রাস্তায় আছে। কথা হবে’।
একটু সামনে এগোতে সাদা পাঞ্জাবি ও টুপি পরা এক জন এগিয়ে এলেন। নাম তার এনামুল হক আকন্দ। তিনি বললেন, ‘কী ড্রাইভিং করবেন? দুই মাসের মধ্যে করে দেব, আপনার কিছু করতে হবে না। আসবেন, পরীক্ষা দেবেন আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে যাবেন। আপনার বাসায় পৌঁছে দেব লাইসেন্স।’ খরচা কেমন হবে? জবাবে বলেন, ‘১২-১৪ হাজার টাকায় করি, আপনার জন্য ১০ হাজার।’
মনোয়ার হাকিম নামের আরেক দালাল দাম কমালেন আরও। তিনি বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে ৫-৭ জনকে ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দেই। আপনি করবেন? টাকা লাগবে ৯ হাজার। পরীক্ষায় বসলেই পাস। এখানকার কর্মকর্তাদের টাকা খাওয়াই। পাস দিয়ে দেবে তারা। এক মাসেই পাবেন অরিজিনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স।’
এসব কথা তিনি বলছিলেন বিআরটিএর পরীক্ষা কক্ষের সামনে। লাইসেন্সপ্রত্যাশীদের ভিড়ে দালালও কম না। পরীক্ষা কমিটির প্রধান এমন সময় উপস্থিত হওয়ায় সবাই দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। পরীক্ষা কক্ষের সামনে শসা-ক্ষীরা বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই দালাল। তাই ম্যাজিস্ট্রেট আসার কথা শুনে চলে গেছেন। শুধু পরীক্ষা কক্ষ নয়, কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ার বিআরটিএ গেটেও জটলা পাকিয়ে থাকে দালালেরা। কেউ গেট দিয়ে ঢুকলেই তারা সম্ভাব্য শিকারি হিসেবে তাকিয়ে থাকেন’।
বিআরটিএ-তে মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে ‘বিশেষ সেবা সপ্তাহ’ চলছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া সেবা সপ্তাহ চলবে আগামী ৪ মার্চ পর্যন্ত। মাঝ মাঠে এ উপলক্ষে একটি আস্থায়ী মঞ্চ করা হয়েছে। মঞ্চ থেকে বিআরটিএ সার্ভিস পোর্টালে এবং মোবাইল অ্যাপে বিআরটিএ সেবা অ্যাকাউন্ট নিবন্ধনের সহায়তা করা হচ্ছে। অনলাইনে শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। মোটরসাইকেল নিবন্ধন ও রেজিস্ট্রেশন সেবা এবং মোটরযানের ফিটনেস অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণ সংক্রান্ত সেবাও দিচ্ছে।
মঞ্চের সামনে এসে পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বে থাকা আনসার নবী হোসেন ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘বিশেষ সেবা সপ্তাহ থাকার কারণে বাইরের লোকজন কম। তা না হলে, এই মাঠে সকাল ৯টাকা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। সেবা সপ্তাহ উপলক্ষে মঞ্চে এসে যে কেউ অভিযোগ করলেই সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেটের ভয়ে বহিরাগতরা বেশিক্ষণ থাকছেন না।’
মঞ্চের বামের ভবনে ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রত্যাশীদের লিখিত পরীক্ষা চলছে। লাইনে দাঁড়িয়ে একের পর এক জন লার্নারের ফটোকপি নিয়ে ঢুকছেন। কেউ একা, কেউ দলে দলে প্রবেশ করছেন। এ সময় দেখা গেল, প্রায় সব আবেদনকারীদের কাগজপত্র সরবরাহসহ বিভিন্ন কথা বলে সহযোগিতা করছেন কিছু দালাল।
নরসিংদী থেকে পরীক্ষা দিতে আসা মুক্তার হোসেন ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘আমার পরিচিত বড় ভাইয়ের (পুলিশ) মাধ্যমে লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স করছি। আজ পরীক্ষা দিতে এসেছি। টাকা নিয়েছে ১১ হাজার। আমি পেশাদার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছি। আমাকে দুই মাসের মধ্যে করে দেবে বলে টাকা নিয়েছে।’
ঘুষ দেওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হয়। তাছাড়া ভালো চিনিও না, বুঝিও না। তাই বড় ভাইকে ধরেছি।’ ভিডিও সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে তিনি রাজি হননি।
পূর্বদিকের গেটে দিয়ে ভবনটির ভেতরে ঢুকেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন লোকজন। লাইন যেন আগাচ্ছে না। কিন্তু সেই সময়ে কাগজ ও লোকজন নিয়ে কক্ষটিতে ঢুকছেন দালালরা। নিয়ম ভঙ্গ করে দালালরা একসঙ্গে ৪-৫ জনকে নিয়ে রুমে ঢুকছেন। এর আগে গার্ডদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে ১০০/২০০ টাকা। এভাবে ফিঙ্গার প্রিন্ট দ্রুত করিয়ে নিচ্ছেন তারা।
অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন সাধারণ মানুষ। মতিঝিল এজিবি কলোনির নিরাপত্তা প্রহরী মুর্শেদ ও আহমদ হোসেন ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘লাইনে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। খরচাসহ আমাদের দুই বন্ধুর লাইসেন্স করতে লাগবে দুই হাজার ৫০০ টাকা। কাউকে ঘুষ দেব না।’
ডেমরা থেকে চার বন্ধুর সঙ্গে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে লাইসেন্স নিতে আসা আশিকুর রহমান ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘আমরা সাড়ে ৯ হাজার টাকা করে দালালদের মাধ্যমে লাইসেন্স করেছি।’
বিআরটিএ ঢাকা সার্কেলের (দক্ষিণ) সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘এখানে দালাল আছে বলে শুনি। কিন্তু আমরা তো দেখি না। আমাদের কাছে কখনও কোনো অভিযোগও আসেনি। এলে ব্যবস্থা নেব।’
এমআই/এইচকে/এফআর