লাইসেন্স প্রত্যাশীদের সঙ্গে দরকষাকষি হয় এই বটতলায় / ছবি : ঢাকা পোস্ট

রাজধানীর খিলক্ষেতে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) জোয়ার সাহারা লাইসেন্স পরীক্ষা কেন্দ্রের গেটে বেশকিছু মানুষের জটলা। পাশেই রাখা ১৫/২০টি মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলের আরোহীসহ আরও অনেকে এসেছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স করাতে। গেটের সামনে অবস্থান নেওয়া একদল দালাল সহজে লাইসেন্স পাওয়ার চটকদার অফার দিচ্ছেন তাদের।

কার্যালয়ের ভেতরে দেখা গেল আরেক দৃশ্য। সেখানে মানুষের পৃথক তিনটি দীর্ঘ সারি। পাশেই একটি রুমে চলছে ১০/১৫ জনের লিখিত পরীক্ষা। পরীক্ষার লাইনে অপেক্ষায় আরও ৬০/৭০ জন। লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের এর আগে আরেকটি দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে হয়েছে পরীক্ষার অনুমোদনপত্র। এখানেই শেষ নয়, সবে শুরু। পরীক্ষায় পাস করলে শুরু হবে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা। পাস করলে দাঁড়াতে হবে আরেকটি (তৃতীয়) লাইনে। সেখানেই হবে ব্যবহারিক পরীক্ষা। প্রত্যেক লাইনে সময় যাবে গড়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা।

নতুন সড়ক পরিবহন আইনে বেড়েছে জরিমানার পরিমাণ। ফলে বৈধ কাগজপত্র পেতে প্রতিদিনই উপচেপড়া ভিড় হচ্ছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) জোয়ার সাহারা লাইসেন্স পরীক্ষা কেন্দ্রে। লাইসেন্সপ্রত্যাশী, লাইসেন্স হালনাগাদকারীদের প্রতিদিনের ভিড়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি- বিআরটিএ হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে।

প্রথমদিনে তিন হাজার টাকা দেবেন আর ই-মেইলে ভোটার আইডিসহ অন্যান্য কাগজপত্র দেবেন। আমি লার্নার করে আপনার মেইলে পাঠিয়ে দেব। এরপর পরীক্ষার দিন এসে শুধু পরীক্ষা দেবেন। পাস করানোসহ সব ব্যবস্থা করে দেব আমরা। পরীক্ষার দিন দেবেন আর তিন হাজার টাকা। বাকি চার হাজার টাকা দেবেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর লাইসেন্সের কাগজ বুঝে নেওয়ার সময়। কী প্রশ্ন করবে, কেমন পরীক্ষা হবে— সব বলে দেব আমি। ব্যবহারিকসহ সব পরীক্ষায় পাস করবেন তরতরিয়ে

মঙ্গলবার (২ মার্চ) সকাল ৯টায় এখানে ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা দিতে এসেছেন জোবায়ের আহমেদ নামের একজন। কিন্তু সাড়ে ১১টায়ও তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। দুটি লাইনে পৃথক পৃথক কাজ শেষ করে তিনি এখনও লাইনে।

জোবায়ের আহমেদ বলেন, দুই মাস আগে লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স করেছিলাম। এখন সেই ডেট অনুযায়ী পরীক্ষা দিতে এসেছি। তবে দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ করতে দিন শেষ হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, ‘লিখিত, ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করলে আরেকদিন এভাবে এসে লাইনে দাঁড়াতে হবে। সেদিন ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেবে। সবমিলিয়ে একটি লাইসেন্স পেতে ৪/৫ মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। সেই সঙ্গে আছে সীমাহীন ভোগান্তি আর বিড়ম্বনা। কিন্তু যারা দালাল ধরে কাজ করছেন তারা ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন। ঝামেলাহীন সব কাজ দ্রুত শেষ করে চলে যাচ্ছেন।’

আগে যারা আবেদন করেছেন তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন। আমরা চার ভাগে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। প্রথমে নির্দিষ্ট চার জেলায়, এরপর বিভাগীয় জেলা শহর, ঢাকা মেট্রো এবং পরবর্তীতে সারাদেশে একযোগে কার্যক্রম চলবে। আঙুলের ছাপ নেওয়ার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণ করা হবে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স

শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী, মুখপাত্র, বিআরটিএ

জোবায়েরের মুখে এমন মন্তব্য শুনে ফের মূল ফটকের সামনে যেতেই দেখা মিলল একদল দালালের। আগত লাইসেন্সপ্রত্যাশীদের তারা পানির মতো সহজে লাইসেন্স পাওয়ার উপায় বাতলে দিচ্ছেন। চটকদার সব অফার দিয়ে চলছে দরদাম।

ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করতে দেখে এগিয়ে এলেন দালাল দলের একজন। মোলায়েম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই লাইসেন্স করাবেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘিরে ধরল একদল দালাল। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে দালালের সঙ্গে শুরু হয় কথোপকথন।

সিরাজুল ইসলাম (ছদ্ম নাম) নামের ওই দালাল বললেন, ‘ভাই ১০ হাজার টাকা লাগবে। সবকিছু আমিই করে দেব। আপনার কোনো ঝামেলা নেই। অফিসারদের আমরা ম্যানেজ করে নেব। আপনি শুধু অ্যাটেন্ড করবেন। মাত্র ১০ হাজার টাকায় লাইসেন্স থাকবে আপনার হাতে।’ 

টাকার পরিমাণ বেশি— এমন ইঙ্গিত দিলে সিরাজুল বলেন, আপনি নিজে করতে গেলে ঝামেলার মধ্যে পড়বেন। অফিসাররা সহজে সহযোগিতা করবেন না। ঘুরে ঘুরে জুতা ক্ষয় হবে, কাজ ফুরাবে না। তাই আসেন আমাদের কাছে, ‘ফেলেন ১০ হাজার, বুঝে নিন কাঙ্ক্ষিত লাইসেন্স।’ 

টাকা দিলে সহজেই লাইসেন্স পাওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা কী— এমন প্রশ্ন করার আগেই সিরাজুল বলেন, ‘আমাদের টাকা দিয়ে লাইসেন্স করালে আপনার কোনো ঝামেলা নেই। অফিসারও এই টাকার ভাগ পাবেন। কাজ হবে নির্বিঘ্নে।’

কাজের প্রক্রিয়া কেমন হবে— জানতে চাইলে ওই দালাল বলেন, প্রথমদিনে তিন হাজার টাকা দেবেন আর ই-মেইলে ভোটার আইডিসহ অন্যান্য কাগজপত্র দেবেন। আমি লার্নার করে আপনার মেইলে পাঠিয়ে দেব। এরপর পরীক্ষার দিন এসে শুধু পরীক্ষা দেবেন। পাস করানোসহ সব ব্যবস্থা করে দেব আমরা। পরীক্ষার দিন দেবেন আর তিন হাজার টাকা। বাকি চার হাজার টাকা দেবেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর লাইসেন্সের কাগজ বুঝে নেওয়ার সময়। কী প্রশ্ন করবে, কেমন পরীক্ষা হবে— সব বলে দেব আমি। ব্যবহারিকসহ সব পরীক্ষায় পাস করবেন তরতরিয়ে।

বিআরটিএ’র জোয়ার সাহারা কার্যালয়ে এসেছেন দুই বন্ধু। এর মধ্যে একজনের লাইসেন্স আছে। বন্ধুর লাইসেন্স পেতে সহযোগিতা করতে এসেছেন তন্ময়। অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি খুব ঝামেলা করে, দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর লাইসেন্সের কাগজ হাতে পেয়েছি। আমি নিজে নিজেই দালাল ছাড়া করেছিলাম। কিন্তু এতে খুব ভোগান্তি। যে কারণে আজ আমার বন্ধুকে এনেছি আর দালালের মাধ্যমে তার লাইসেন্স করাচ্ছি। সাড়ে নয় হাজার টাকা দালাল নেবে। যদিও মোটরসাইকেল, লাইট লাইসেন্স করাতে সরকারি খরচ লাগে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন হাজার টাকা। বাকিটা দালালকে দিতে হচ্ছে।’

জানা গেছে, আট লাখের বেশি লাইসেন্সপ্রত্যাশী ইতোমধ্যে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েছেন এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছেন। তবে সরবরাহ বন্ধ থাকায় অভিযোগ ও ভোগান্তি ছিল অনেক। এ বিষয়ে বিআরটিএ বলছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা বন্ধ ছিল। সেবা চালুর পর চাপ আরও বেড়েছে। এছাড়া দীর্ঘ সময় স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রিন্টিং বন্ধ থাকায় ঝুলতে থাকা প্রত্যাশীর সংখ্যা এখন প্রায় নয় লাখ। যদিও এ সময়ে প্রায় দুই লাখ কাগুজে ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ করা হয়েছে।

ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়ে বিআরটিএ’র মুখপাত্র (পরিচালক, রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, “আগে বিআরটিএ’র সঙ্গে চুক্তি ছিল টাইগার আইটি’র। তারা বাদ যাওয়ার পর দুবার টেন্ডার হয়। গত বছরের ২৯ জুলাই পাঁচ বছরের জন্য মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়। প্রতিষ্ঠানটি মেশিনারিজ, সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার স্থাপনের কাজ শেষ করেছে। শুরু হয়েছে লাইসেন্সপ্রার্থীদের আঙুলের ছাপ নেওয়ার কার্যক্রম।”

তিনি আরও বলেন, ‘আগে যারা আবেদন করেছেন অর্থাৎ বেশি সময় অপেক্ষায় থাকা প্রত্যাশীরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন। আমরা চার ভাগে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। প্রথমে নির্দিষ্ট চার জেলায়, এরপর বিভাগীয় জেলা শহর, ঢাকা মেট্রো এবং পরবর্তীতে সারাদেশে একযোগে কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আঙুলের ছাপ নেওয়ার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণ করা হবে স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স।’

ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে যা করতে হয়

অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ন্যূনতম ১৮ বছর এবং পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম ২০ বছর বয়সীরা আবেদন করতে পারবেন। লাইসেন্স দেওয়া হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে।

ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রথম ধাপ হলো- শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্সের (লার্নার) জন্য আবেদন করা। প্রথমে এর জন্য বিআরটিএ থেকে বা ওয়েবসাইট থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ জমা দেওয়া।

শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র-

১. নির্ধারিত ফরমে আবেদন। 
২. রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের দেওয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট। 
৩. ন্যাশনাল আইডি কার্ড/জন্মসনদ/পাসপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি। 
৪. নির্ধারিত ফি, ক্যাটাগরি ১- ৩৪৫ টাকা ও ক্যাটাগরি ২- ৫১৮ টাকা বিআরটিএ’র নির্ধারিত ব্যাংকে (ব্যাংকের তালিকা www.brta.gov.bd তে পাওয়া যাবে) জমাদানের রশিদ। ক্যাটাগরি ১- শুধু মোটরসাইকেল অথবা শুধু হালকা মোটরযান। ক্যাটাগরি ২- মোটরসাইকেল এবং হালকা মোটরযান একসঙ্গে। 
৫. সদ্য তোলা তিন কপি স্ট্যাম্প ও এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।

এরপর আবেদনপত্রটি নিজ হাতে পূরণ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ নিজ এলাকা অনুযায়ী বিআরটিএ’র সার্কেল অফিসে জমা দিতে হবে। সার্কেল অফিস থেকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেবে। এরপর তাদের দেওয়া সময় অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। এ সময় লার্নারের মূল কপি নিয়ে যেতে হবে।

লিখিত, মৌখিক ও ফিল্ড টেস্টে উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুনরায় একটি নির্ধারিত ফরমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ফি দিয়ে স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিসে আবেদন করতে হবে। গ্রাহকের বায়োমেট্রিক (ডিজিটাল ছবি, ডিজিটাল স্বাক্ষর ও আঙুলের ছাপ) গ্রহণ করে স্মার্ট কার্ড ইস্যু করা হয়। স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্টিং সম্পন্ন হলে গ্রাহককে এসএমএসের মাধ্যমে তা গ্রহণের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়। স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করার পর বিআরটিএ একটি প্রাপ্তি রিসিট গ্রাহককে দেবে। যা স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স না পাওয়া পর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স হিসেবে গণ্য হবে।

স্মার্ট কার্ড লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

১. নির্ধারিত ফরমে আবেদন। 
২. রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের দেওয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট। 
৩. ন্যাশনাল আইডি কার্ড/জন্মসনদ/পাসপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি। 
৪. নির্ধারিত ফি (পেশাদার- ১৬৮০ টাকা, অপেশাদার- ২৫৪২ টাকা) বিআরটিএ’র নির্ধারিত ব্যাংকে জমাদানের রশিদ। 
৫. পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন। 
৬. সদ্য তোলা এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি।

অপেশাদার লাইসেন্স ১০ বছর পরপর নবায়ন করাতে হবে। পেশাদার লাইসেন্স ৫ বছর পরপর নবায়ন করাতে হয়।

আরও পড়ুন: ড্রাইভিং লাইসেন্স করবেন যেভাবে

এএসএস/এইচকে/এমএআর