দূতকে আপ্যায়ন না করে ‘বিরক্তি’ বুঝিয়ে দিল ঢাকা
ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়ে-কে এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে চারবার তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নেপিদোর এ দূতকে ডেকে আনা যেন ‘রুটিন কূটনীতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে মিয়ানমারের গোলাগুলির ঘটনায় রীতিমতো চরম বিরক্ত ঢাকা।
রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) এ বিরক্তিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ঢাকার তলবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এলে রাষ্ট্রদূত মোয়ে-কে কোনো আপ্যায়ন করা হয়নি। এক কাপ চা পর্যন্ত রাষ্ট্রদূতসহ সঙ্গে থাকা সঙ্গীকে দেওয়া হয়নি বলে নিশ্চিত করেছে মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।
বিজ্ঞাপন
সূত্র জানায়, আধা ঘণ্টার কাছাকাছি সময় রাষ্ট্রদূত মো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক নাজমুল হুদার দপ্তরে অবস্থান করেন। সীমান্তে গোলাগুলি, মর্টার শেল নিক্ষেপ ও রোহিঙ্গা হতাহতের বিষয়টি তুলে ধরে ঢাকা। কূটনীতিক রীতি বা প্রথা অনুযায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি কূটনীতিকদের আপ্যায়ন করে থাকলেও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের আজ খাবার-পানি কিছুই দেওয়া হয়নি।
আতিথেয়তায় সুনাম থাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন আচরণের কারণ হিসেবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বারবার তলব করার পরও মিয়ানমারের দিক থেকে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাই হয়তো পরিস্থিতি বিবেচনায় এমনটি হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের ৪৮ মিনিট
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের ভেতরে গোলা এসে পড়ার ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মো-কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোববার সকালে হাজির হতে বলা হয়। বেলা ১১টা ২১ মিনিটে পতাকাবিহীন গাড়ি নিয়ে হাজির হন তিনি।
রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ছিলেন দূতাবাসের আরেক কূটনীতিক। মন্ত্রণালয়ের মূল বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি থেকে নেমে তাড়াহুড়ো করে ভেতরে ঢুকে পড়েন রাষ্ট্রদূত। রাষ্ট্রদূতসহ তার সঙ্গী ভেতরে প্রবেশ করলে ১০ থেকে ১১ মিনিট অপেক্ষা কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়।
সিঁড়িতে সাংবাদিকদের অবস্থান বুঝতে পেরে অপেক্ষা কক্ষ থেকে লিফট হয়ে মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক নাজমুল হুদার দপ্তরে যেতে চেষ্টা করেন অং কিউ মোয়ে। এরপরও সাংবাদিকদের সামনে পড়তে হয় তাকে। মাস্কে মুখ লুকিয়ে কোনো রকমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার রুমে যান তিনি।
প্রায় আধা ঘণ্টার কাছাকাছি সময় নাজমুল হুদার দপ্তরে অবস্থান করেন তিনি। বের হওয়ার পর সাংবাদিকরা কথা বলার চেষ্টা করেন। তবে রাষ্ট্রদূত এবং তার সঙ্গী তাড়াহুড়ো করে ১২টা ৯ মিনিটে মন্ত্রণালয় ছাড়েন।
রাষ্ট্রদূতকে যে বার্তা দিয়েছে ঢাকা
দুপুরে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়ে-কে তলব করার কয়েক ঘণ্টা পর ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। তিনি রাষ্ট্রদূতকে দেওয়া ঢাকার বার্তা তুলে ধরেন।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আজ আমরা মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদলিপি দিয়েছি। সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না হয় আমরা সেটা বলেছি। আরও বলেছি, এটি আপনাদের (মিয়ানমারের) অভ্যন্তরীণ বিষয়। কীভাবে সমাধান করবেন, তা মিয়ানমারকে চিন্তা করতে হবে।
খুরশেদ আলম বলেন, ধৈর্যের সঙ্গে অনেক দিন ধরে এসব সহ্য করে যাচ্ছি। আমরা তাদের বলেছি, আপনারা আপনাদের সমস্যা সমাধান করুন, যাতে আমাদের এখানে কোনো রক্তারক্তি না হয়, কোনো প্রাণ না যায়।
বাংলাদেশের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের অবস্থান কী ছিল— জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব জানান, তাদের উত্তর গতানুগতিক। তাদের দাবি, গোলাগুলি চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এসব তথ্য তিনি নেপিদোতে জানাবেন তাদের কর্তৃপক্ষকে, তারা যেন এ নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।
খুরশেদ আলম বলেন, রাষ্ট্রদূতের একটি বক্তব্য আছে। তার বক্তব্য, গোলাগুলির ঘটনা আরাকান আর্মি চালাতে পারে। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আপনাদের দেশের ভেতর থেকে যা কিছু আসুক, সেটা আপনাদের দায়িত্ব। সেটা আপনারা দেখবেন। আমাদের এপারে যাতে কিছু না আসে, তা আপনারা নিশ্চিত করবেন। এর জন্য যা করার দরকার, আপনারা পদক্ষেপ নেবেন।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, মিয়ানমার থেকে গুলিটা কে করেছে। কারণ গুলির গায়ে লেখা ‘মিয়ানমার আর্মি’। মিয়ানমার বলছে, এসব গুলি চুরি করে আরাকান আর্মি নিয়ে গেছে। তারা এখন গুলি করছে, যাতে করে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনার সমাধান কোথায়— এমন প্রশ্নের জবাবে খুরশেদ আলম বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা কি সমাধান হচ্ছে? আমরা পাঁচ বছর ধরে জাতিসংঘসহ এমন কোনো জায়গা নেই, বড় কোনো দেশ নেই যাদের কাছে আমরা যাইনি, ধরনা দিইনি; সমস্যার সমাধান হয়েছে? ইউএনএইচসিআর কি পারছে? কাজেই দ্বিপাক্ষিক ইস্যু সমাধানে সময় লাগবে। ধৈর্য ধরতে হবে। তবে আমরা যদি নিজেরা নিজেদের মধ্যে শক্ত থাকি, সমাধান আসবে।
এখনই সীমান্তে সেনা মোতায়েন নিয়ে ভাবছে না সরকার
এদিকে চলমান গোলাগুলির ঘটনায় এখনই মিয়ানমার সীমান্তে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে সরকার ভাবছে না বলে জানিয়েছেন খুরশেদ আলম।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের দূতের সঙ্গে কথা বলার পর আমরা আজ একটি উচ্চ পর্যায়ের মিটিং করেছি সবাইকে নিয়ে। বাংলাদেশের যত এজেন্সি আছে, তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছি এবং বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে বলে দিয়েছি বর্ডারে সজাগ থাকতে। রি-এনফোর্সমেন্ট যেখানে যতটুকু লাগে, করবে।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব বলেন, সাগর দিয়ে বা অন্য জায়গা দিয়ে কোনো রোহিঙ্গা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখার অনুরোধ করেছি। তবে আমাদের দেশেরও কিছু লোক আছে, তারা আগেরবার জড়িত ছিল রোহিঙ্গা আসার পেছনে, সেটা যেন এবার না হয়। এবার আমরা আমাদের যত এজেন্সি আছে সবাইকে রিকোয়েস্ট করেছি।
কী চলছে সীমান্তে
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে নতুন করে গোলাগুলি শুরু হয়। রাত ৮টার দিকে একটি মর্টার শেল এসে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় পড়ে। এতে এক রোহিঙ্গা যুবকের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় এক শিশুসহ পাঁচ রোহিঙ্গা নাগরিক আহত হন। তারা এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এর আগে কয়েক দফায় মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল ও গোলা এসে পড়ে বাংলাদেশের ভেতরে। ওইসব ঘটনায়ও মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। তবে, বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করে বলছেন, এমন মৌখিক প্রতিবাদ কার্যকর কিছু নয়।
এনআই/আরএইচ/জেএস