সাবরিনা ইয়াসমিন সোনালী কক্সবাজার সিটি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। কাজ করতেন ফ্লাই ডাইন হোটেলে। কক্সবাজারের সুগন্ধা সৈকতধারের এ তরুণীর চাকরি হয়েছে সায়মন লং বিচ হোটেলে।

এ সুযোগ তৈরি হয়েছে হোটেল সার্ভিসে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কারণে। আর সেটি করে দিয়েছে র‍্যাব। সোনালী এখন পড়াশোনার খরচ মেটানোর পাশাপাশি পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন।

সোনালীর মতো ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী এমন ৩৬ জনকে আলোর পথে আনার উদ্যোগ নেয় র‍্যাব, যাদের অনেকেই ছিলেন বেকার, অর্ধশিক্ষিত, অবলম্বনহীন এবং অপরাধে জড়ানোর ঝুঁকিতে।

‘অপরাধকে না বলুন’— স্লোগানকে সামনে রেখে অপরাধ প্রতিরোধবিষয়ক স্ট্র্যাটেজির আওতায় নতুন কর্মসূচি নিয়েছে এলিট ফোর্স র‍্যাপিড আ্যকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। ‘নবজাগরণ’ শীর্ষক এ কর্মসূচির আওতায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বা ঝুঁকিতে থাকা ৩৬ তরুণ-তরুণীকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নেয় র‍্যাব।

তাদের ছয়জনকে হোটেল সার্ভিস, পাঁচজনকে সার্ফিং, পাঁচজনকে ট্যুরিস্ট গাইড প্রশিক্ষণ, পাঁচজনকে ফটোগ্রাফি প্রশিক্ষণ, ১০ জনকে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ আর পাঁচজনকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেয় র‍্যাব। ইতোমধ্যে তাদের অনেকেই চাকরি পেয়েছেন, কেউ পেয়েছেন স্বাবলম্বী হবার সুযোগ।

রামু দক্ষিণ মিঠাছরির সেলিনা আক্তার পড়াশোনা করছেন কক্সবাজার মহিলা কলেজে। বাবা আব্দুল মা’বুদ দিনমজুর। সেলিনা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান। এজন্য দরকার ছিল স্বাবলম্বী হওয়া। সুযোগ পেয়ে সেলাই মেশিনের কাজ শিখেছেন সেলিনা। এখন নিজের বাড়িতে থেকেই নারীদের জামা-কাপড় তৈরি করা শুরু করেছেন সেলিনা।

সেলিনা বলেন, ‘আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, স্বাবলম্বী হওয়ার পথে র‍্যাবকে পাশে পেয়েছি। আগে আমি মানুষের কাছে যেতাম, এখন মানুষই আমার কাছে আসবে। শুধু নিজের খরচ নয়, পরিবারের পাশে থাকার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা আমার জন্য বিশেষ কিছু। এজন্য র‍্যাবকে ধন্যবাদ।

এ কর্মশালার আওতায় সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নেওয়া মারমা তরুণী লাম নু খাই জানান, নানাভাবে পিছিয়ে থাকলেও এ প্রশিক্ষণ জীবনে আলো নিয়ে এসেছে। সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ তাকে স্বাবলম্বী করেছে। তিনি এখন সুন্দর ও স্বনির্ভর জীবনযাপন করতে চান। 

যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন শুধু তারাই নন, তাদের অভিভাবকরাও র‍্যাবের এ কাজের প্রশংসা করেন। কক্সবাজার হাজিপাড়া পাওয়ার হাউজের বাসিন্দা হেলাল দেওয়ান জানান, দুই বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ভাই নুরুল আমিন মুন্না। কিছুই করতেন না। মাদকপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ভাইকে নিয়ে খুব আতঙ্কে থাকতেন। কখন কী করে বসেন। তবে র‍্যাবের ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ তার ভাইকে সুযোগ করে দিয়েছে কাজের।

আট বছর ধরে বিল্লাল হোসেন লং বিচ হোটেলে সার্ভিসের কাজ করছেন। বিল্লাল বলেন, নিজেও বেকার ছিলাম। বেকারত্ব ঘোচাতে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে ১০ বছর আগে কক্সবাজারে আসি। এ হোটেলে আট বছর ধরে হাউজ কিপিংয়ের কাজ করছি। বেকারত্ব ঘোচাতে এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।

কক্সবাজারের প্রাণকেন্দ্র কলাতলীর বাসিন্দা সৈয়দ হোসেন, মেলেনি পড়াশোনার সুযোগ। সার্ফিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি পেয়েছেন আলোর দিশা৷ তিনি বলেন, পড়াশোনা শিখিনি। কিছু একটা তো করতে হবে। সি সার্ফিংয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু শেখার সুযোগ পাইনি। র‍্যাবের সহযোগিতায় সি সার্ফিং শিখেছি। আমি এখন নিজেই সার্ফিং ক্লাব করব, এখন শেখাতেও পারব।

‘নবজাগরণ’ শীর্ষক কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে ৩৬ প্রশিক্ষণার্থীর হাতে প্রশিক্ষণের সনদ তুলে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।  বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে কক্সবাজারের লং বিচ হোটেলের বলরুমে এ সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে র‍্যাব।

অনুষ্ঠানে র‍্যাবের নবজাগরণ কর্মসূচি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, যেসব এলাকা ভালনারেবল, জনসংখ্যা অতিরিক্ত এবং কর্মসংস্থান কম, সেখানকার মানুষকে টার্গেট করেছে র‍্যাব। তারা যাতে অপরাধে জড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্য তাদের আলোর পথ দেখানো হচ্ছে । এটি নিঃসন্দেহে একটি সাহসী উদ্যোগ। সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো আলোকিত বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে একসঙ্গে বেঁচে থাকবে, আমরা এটিই চাই।

তিনি বলেন, এমন একটি জায়গায় কাজটি করছে র‍্যাব, যেখানে সবাই একবার হলেও এখানে আসতে চায়। ট্যুরিস্ট পুলিশসহ পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, আনসার বাহিনী রয়েছে এ কক্সবাজারে। সবার একটিই উদ্দেশ্য, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি যেন ধরে রাখতে পারি।

র‍্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, কক্সবাজার র‍্যাব-১৫ এর ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ৩৬ জন প্রশিক্ষণার্থীকে সেলাই, ড্রাইভিং, টুরিস্ট গাইড, ফটোগ্রাফি, রেস্টুরেন্ট সার্ভিস ও সার্ফিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রশিক্ষণার্থীদের আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে এবং প্রশিক্ষণ শেষে অনেককে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের বিভিন্ন উপকরণও দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, আমি আশা করি, এখানে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে ভবিষ্যতে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে নিজে বিরত থাকবেন এবং অন্যান্যদেরও বিরত রাখবেন। যারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত তারা সে পথ থেকে ফিরে এসে আপনাদের দেখে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ পাবেন।

র‍্যাব মহাপরিচালক মামুন বলেন, অপরাধপ্রবণ লোকদের চিহ্নিত করে তাদের নবজাগরণ কর্মসূচির আওতায় সুন্দর জীবন গঠনের পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে অপরাধে জড়াতে নিরুৎসাহিত করা। আর এভাবে সমাজে অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

কক্সবাজারের ডিসি মো. মামুনুর রশিদ বলেন, র‍্যাবের অন্য কার্যক্রমের মতো এ কার্যক্রমের প্রতিফলন আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। কক্সবাজার নানা দিক থেকে অপরাধপ্রবণ এলাকা।  এ কর্মসূচির মাধ্যমে কক্সবাজার জেলা অপরাধমুক্তির পথে অনেকখানি এগিয়ে যাবে।

জেইউ/আরএইচ