দুদকের মামলার প্রস্তুতি
স্ত্রীর আড়াই কোটি টাকার সম্পদে ফাঁসছেন এমপি জিন্নাহ
মিসেস মোহসীনা আকতার। পেশায় গৃহিণী হলেও আড়াই কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক। হবেই না কেন? স্বামী বগুড়া-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ। যিনি ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সম্পদের মামলারও আসামি।
জাতীয় পার্টি নেতা ও এমপি জিন্নাহর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলাকালীন স্ত্রী’ নামে সম্পদ দেখিয়ে নিজে পার পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। স্ত্রীকে ব্যবসায়ী দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকি নিয়মিত করদাতাও সাজিয়েছেন জিন্নাহ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। উল্টো আগেই নিজে মামলায় ফেঁসেছেন। এবার তার স্ত্রীসহ আবার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ফাঁসতে যাচ্ছেন। তবে এবার স্ত্রী মিসেস মোহসীনা আকতার প্রধান আসামি ও তিনি সহযোগী আসামি হতে যাচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে জাতীয় পার্টির বগুড়া-২ আসনের সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর বিরুদ্ধে ২০২১ সালে মামলা হয়েছিল। ওই মামলার সূত্র ধরেই তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পৃথক অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানে আড়াই কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। যে কারণে কমিশন মামলার অনুমতি দিয়েছে। আজ বা কাল (সোমবার) মামলা দায়ের হতে পারে।
আরও পড়ুন : পুলিশ কর্মকর্তা শাহজাহানের স্ত্রীর দেড় কোটি টাকার সম্পদ ফ্রিজ
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বগুড়া-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানকালে তার স্ত্রী মিসেস মোহসীনা আকতারের নামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্পদ বিবরণী নোটিশ ইস্যুর সুপারিশ করার জন্য দুদকের তৎকালীন অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম সুপারিশ করেন। ওই সুপারিশে কোটি টাকার বেশি সম্পদের সন্দেহজনক তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। যা মূলত তার স্বামী শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর বলে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। ওই সুপারিশকে বিবেচনায় নিয়ে মোহসীনা আকতারের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করে দুদক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি মোহসীনা আকতার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও দায়-দেনার বিবরণ দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বরারব দাখিল করেন।
দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে যা ছিল
মোহসীনা আকতার তার দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে নিজ নামে ৩০ লাখ ৯১ হাজার ৮০০ টাকার স্থাবর ও ২ কোটি ৪ লাখ ৮১ হাজার ১৯৭ টাকার অস্থাবর সম্পদের বিবরণ দেন। সব মিলিয়ে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদসহ ২ কোটি ৩৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকার সম্পদ অর্জনের কথা বলা হয়। সম্পদ বিবরণী ও আয়কর নথি অনুসারে তার প্রদর্শিত সম্পদের মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন ব্যবসার মাধ্যমে আয় দেখানো হয় ১০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০২০ কর বর্ষে ১৯(ই) ধারায় ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬০৯ টাকা জরিমানা আয়কর দিয়ে ৫৪ লাখ টাকা আয় প্রদর্শন করেন তিনি।
২০২১-২২ করবর্ষ পর্যন্ত প্রদর্শিত মোট ২ কোটি ৮ লাখ ৬ হাজার ৮৯২ টাকা আয়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ৭ লাখ ৪২ হাজার ৭৫০ টাকার। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে মোট ২ কোটি ৬১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭২ টাকার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
প্রসঙ্গত আয়কর অধ্যাদেশে ১৯(ই) ধারা অনুযায়ী, অতীতের যে কোনো বছরের আয় গোপন করা হয়ে থাকলে ১০ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে বৈধ করা যাবে। ওই করবর্ষেও তার প্রবাসী ভাইয়ের কাছ থেকে ৪৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা রেমিট্যান্স আয়ের কথা বলা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে যা পাওয়া যায়
অনুসন্ধানকালে মোহসীনার সম্পদ বিবরণী যাচাই-বাছাইকালে ৩০ লাখ ৯২ হাজার টাকার স্থাবর ও ২ কোটি ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৯ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্যসহ মোট ২ কোটি ৪০ লাখ ৩৯ হাজার টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ দাখিলকরা সম্পদ বিবরণীতে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ১৪২ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন : কলেজ করণিকের হিসাবে ২৪ কোটি টাকা!
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আসামি মোহসীনা আকতার এবং তার স্বামীর বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান শুরুর পর তার অবৈধ আয়কে বৈধ করার জন্য ২০১৯-২০২০ করবর্ষে মোহসীনা আকতার আয়কর নথি খোলেন। ওই করবর্ষে তিনি বিবিধ ব্যবসার আয় বাবদ ১০ লাখ টাকা, ১৯ই ধারায় ৫৪ লাখ টাকা আয় দেখিয়ে ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬০৯ টাকা আয়কর দিয়েছেন। ওই করবর্ষে তিনি তার প্রবাসী ভাইয়ের কাছ থেকে ৪৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা রেমিট্যান্স পেয়েছেন। এভাবে তিনি ১ কোটি ৫২ লাখ ২২ হাজার টাকা প্রদর্শন করেন। যার বিপরীতে ১ কোটি ৯ লাখ ৭২ টাকার গ্রহণযোগ্য উৎস পাওয়া গেলেও ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকার আয়ের কোনো বৈধ উৎস পায়নি দুদক।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, মোহসীনা আকতার একজন গৃহিণী। তার আয়ের কোনো উৎস নেই। তার এক ভাই সৌদি আরবে থাকেন। নিজ ব্যাংক হিসাবে ২০১৪ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা রেমিট্যান্স আসে। কিন্তু ওই টাকা তাদের দান করেছেন কি না তার কোনো তথ্য ও রেকর্ডপত্র প্রদর্শন করেননি তিনি। দুদক মনে করে মোহসীনা আকতার তার স্বামীর অবৈধ আয়কে বৈধ করার জন্য তার সৌদি প্রবাসী ভাইয়ের টাকা আনার বিষয়টি সাজিয়েছেন।
আরও পড়ুন : ৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ : আশফাক আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা
সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে দেখা যায়, মোহসীনা আকতারের স্বামী শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ বিগত তিন বার সংসদ সদস্য হিসেবে কর্মরত। তার নিজের কোনো গ্রহণযোগ্য ও বাস্তব আয়ের উৎস নেই। মূলত সংসদ সদস্য স্বামীর অবৈধ আয়কে বৈধ করার অসৎ উদ্দেশে তার নিজ নামে বিবিধ ব্যবসায়ী হিসেবে আয়কর নথি খুলেছেন। ২০২১-২২ করবর্ষ পর্যন্ত প্রদর্শিত মোট ২ কোটি ৮ লাখ ৬ হাজার ৮৯২ টাকা আয়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ৭ লাখ ৪২ হাজার ৭৫০ টাকার। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে মোট ২ কোটি ৬১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭২ টাকার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। যে কারণে বগুড়া-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. শরিফুল ইসলাম জিন্নাহকে সহযোগী আসামি ও তার স্ত্রী মোহসীনা আকতারকে প্রধান আসামি করা হচ্ছে।
শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর বিরুদ্ধে করা মামলায় ১ কোটি ৫৯ লাখ ৭৮ হাজার ১১৩ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৮৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৮ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়। এর আগে তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দেয় দুদক
তাদের বিরুদ্ধে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ১৪২ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে ২ কোটি ৬১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭২ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে অনুমোদিত মামলায়। যেখানে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬(২), ২৭(১) ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা অভিযোগ আনা হয়েছে।
জিন্নাহর বিরুদ্ধে দুদকের মামলায় যা ছিল
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ কমিশনের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় তার বিরুদ্ধে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৭৮ হাজার ১১৩ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৮৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৮ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়। এর আগে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দেয় দুদক। এরপর তার দাখিল করা সম্পদ বিবরণী যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানে ওই অবৈধ সম্পদ ও তথ্য গোপনের প্রমাণ পেয়ে মামলা করা হয়।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির বগুড়া-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ মুহূর্তে বিস্তারিত বলতে পারবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি রাজনৈতিক হয়রানির শিকার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমার বৈধ ব্যবসা আছে, নিয়মিত কর দেই। তারপরও আমাকে ইচ্ছা করে হয়রানি করা হচ্ছে।
বিষয়টিকে আগামী নির্বাচনে তাকে আটকানো কৌশল হিসেবে ইঙ্গিত করে জিন্নাহ বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করি। তাই এটা আমাকে আটকানোর কৌশল মনে হচ্ছে। এছাড়া আমার স্ত্রী ছোট-খাট ব্যবসা করেন। নিয়মিত করও দিচ্ছেন।
আরএম/এসএম