বেশ ক’জন ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে চক্রের মূলহোতাসহ তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

উচ্চ বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কম্বোডিয়াতে নিয়োগের কথা বলে  দেশটিতে নিয়ে গিয়ে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশি চাকরি প্রত্যাশীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে একটি চক্র। চক্রের খপ্পরে পড়া এ চাকরি প্রত্যাশীরা চাকরি তো পাননি, উল্টো হয়েছেন ‘সাইবার ক্রীতদাস।’

বেশ ক’জন ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে চক্রের মূলহোতাসহ তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব-৩।

র‌্যাব-৩-এর স্টাফ অফিসার (মিডিয়া) সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ফারজানা হক বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ এর একটি দল মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর পল্টন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে কম্বোডিয়ায় মানবপাচার চক্রের মূলহোতা নাজমুল ইসলাম (৩০), নূর ইসলাম সাজ্জাদ (২৫), এবং মো. সিরাজুল ইসলাম পঞ্চায়েতকে (৫৭) গ্রেপ্তার করে।

এ সময় তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ৩টি, মোবাইল ফোন ৪টি, রেজিষ্টার ১টি, মানবপাচার সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র ২৫০ পাতা এবং নগদ ৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। 

এএসপি ফারজানা আক্তার বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তাররা সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্রের সদস্য। চক্রের মূলহোতা কম্বোডিয়া প্রবাসী নাজমুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে উচ্চ বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি দেয়ার নাম করে ভিকটিম এবং তাদের অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করেন। কম্বোডিয়ায় প্রেরণের খরচ বাবদ প্রাথমিকভাবে তারা ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা নেয়।

আগ্রহী বেকার তরুণ-তরুণীদের প্রথমে কম্পিউটার বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। উত্তীর্ণ হলে কম্বোডিয়া প্রবাসী আলীম ও শরিফুলের সহায়তায় তাদের জন্য কম্বোডিয়ান ট্যুরিস্ট ই-ভিসা করা হয়। তারপর তাদেরকে বিমানযোগে কম্বোডিয়ায় পাঠানো হয়।

কম্বোডিয়ায় যাওয়ার পর নাজমুল তার সহযোগী কম্বোডিয়া প্রবাসী রাকিব ও রফিকের সহায়তায় প্রথমে ভিকটিমদের প্রবাসী আরিফের হোটেলে নিয়ে যায় এবং তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করার পর তাদেরকে কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য কম্বোডিয়া প্রবাসী কামাল ওরফে লায়ন কামাল ও আতিকের সহায়তায় একটি বিদেশি ট্রেনিং সংস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিদেশি প্রশিক্ষকরা ভিকটিমদের ছদ্মনামে অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে কিভাবে প্রতারণা করা যায়, ভুয়া ক্লোনড ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল, ভুয়া নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে বা চ্যাটিং করে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার নাম করে কৌশলে ডিপোজিট হাতিয়ে নেওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকর্ডিং করে পরবর্তীতে ব্লাকমেইল করে অর্থ আত্মসাৎ করার কৌশল শেখানো হয়।   

আরও পড়ুন : কয়েকবছর আগে ছিলেন কুলি, এখন কোটিপতি

গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে পাসপোর্ট, মোবাইল ফোনসহ নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। 

ট্রেনিং শেষে ভিকটিমদের একটি বিদেশি কোম্পানির কাছে দুই হাজার থেকে তিন হাজার ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তারপর ভিকটিমদের একটি সুরক্ষিত ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। ভবনে যাওয়ার পর তাদের দেহ তল্লাশী করে সকল প্রকার ইলেকট্রনিক ডিভাইস তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়।

তারপর তাদের একটি কম্পিউটার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে একটি বৃহৎ কক্ষে ৩০০ থেকে ৪০০ ডেস্কটপ কম্পিউটার সাজানো থাকে। মানবপাচারকারীদের ভাষায় ওই ল্যাবকে ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্ম বলা হয়।

কম্পিউটার ব্যবহার করে ভিকটিমদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুরুষদের সাথে ছদ্মনামীয় নারী অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এবং নারীদের সাথে ছদ্মনামীয় পুরুষ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বাধ্য করা হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর ভিডিও কল দিয়ে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়। তারপর সেসব রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

আবার কখনও উপহার পাঠানো, দেখা করার জন্য যাতায়াত খরচের প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল চক্রটি। এসব কাজে টিকটক, বিটকয়েন, ফেক ওয়েবসাইটের সহায়তা নেওয়া হয়। 

এ কাজে হতাশাগ্রস্ত ও  অপেক্ষাকৃত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করা হয়। আবার কখনও যেসব ব্যক্তি ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন বা ঋণ নিতে ইচ্ছুক, এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করে তাদের কম সুদে আকর্ষণীয় ঋণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবে রাজি হলে ডিপোজিট বাবদ ৫ শতাংশ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করতে বলা হয়। অর্থ আত্মসাৎ করার পর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়।  

আরও পড়ুন : ধার করা সন্তান দেখিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে শিক্ষিকা 

ফারজানা হক আরও বলেন, কেউ টার্গেট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে বা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে নির্যাতন করা হয়। তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেউ অব্যাহতি চাইলে তাকে কিনতে যে ডলার ব্যয় করা হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দিতে বলা হয় এবং সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো অভিযোগ করবে না মর্মে অঙ্গীকারনামা নেওয়া হয়। তখন ভিকটিম বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে কোম্পানিতে অর্থ ফেরত দিয়ে কম্বোডিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি দালালদের আশ্রয়ে যায়। তখন দালালরা ভুক্তভোগীদের আবার আরেকটি সাইবার প্রতারক কোম্পানিতে বিক্রি করে দেয়।

যদি কেউ দেশে ফিরে আসতে চায়, তখন দেশে ফেরত যাওয়ার শর্ত হিসেবে আরও গ্রাহক সংগ্রহ করে দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। এ সময় ভুক্তভোগীদের কম্বোডিয়ায় থাকা খাওয়ার খরচ নিজেকে বহন করতে হয়। রোজগার না থাকায় তারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবৈধ কাজ করতে বাধ্য হয়। নতুবা দেশ থেকে টাকা নিয়ে থাকা-খাওয়ার ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। অনেকে বাঁচতে নিরুপায় হয়ে নিজে মুক্তি পাওয়ার জন্য পরিচিত অপর বাংলাদেশিদের কম্বোডিয়ায় আসতে প্ররোচিত করে। তারপর কম্বোডিয়া প্রবাসী আলীম ও শরিফুল তাদের ই-ভিসার ব্যবস্থা করে কম্বোডিয়ায় নিয়ে গিয়ে ভিকটিমদের একইভাবে সাইবার ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এভাবে চক্র সারা বাংলাদেশ থেকে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশিকে সাইবার ক্রীতদাস হিসেবে কম্বোডিয়ায় প্রেরণ করেছে। 

জেইউ/এনএফ