আমি তো নীলকণ্ঠ হয়ে বেঁচে আছি, সংসদে প্রধানমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার চক্রান্তের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি তো নীলকণ্ঠ হয়ে বেঁচে আছি। অনেক কিছু জানি- বলতে পারব না, বলি না। কারণ আমার একটাই লক্ষ্য, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। এটা যখন স্বার্থকভাবে করতে পারব, তখনই আমার অনেক কিছু বলার সুযোগ আসবে।
বুধবার (৩১ আগস্ট) জাতীয় সংসদে ১৪৭ বিধির ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর আনা প্রস্তাবটি পরে সর্বসম্মতক্রমে গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও এতে ২৪ জন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন।
মোকতাদির চৌধুরীর প্রস্তাবটি ছিল- ‘এই মহান সংসদের অভিমত এই যে, যে ঘৃণ্য খুনিচক্র ও চক্রান্তকারী গোষ্ঠী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্টের শহীদদেরকে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জানাচ্ছি। কিন্তু চক্রান্তকারীদের প্রেতাত্মারা এখনো ক্ষান্ত হয়নি। আজও তারা ঘৃণ্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে এসে ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিতে। তাদের এই ঘৃণ্য চক্রান্তকে সফল হতে দেওয়া যায় না। ইতিহাসের পাদদেশে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা, বাঙালির মহত্তম ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল শহীদকে বিনম্র চিত্তে ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি এবং বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সকল চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেওয়ার শপথ গ্রহণ করছি, ২০২২-এর আগস্ট মাসে একাদশ জাতীয় সংসদের উনবিংশতম অধিবেশনে এই হোক প্রত্যয় দৃঢ় ঘোষণা।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে কমিশন গঠন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা সরাসরি হত্যার সাথে জড়িত তাদের বিচার হয়েছে। অনেকের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এই চক্রান্তটা তো শুধু হত্যাকাণ্ড নয়। চক্রান্তটি আমাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এই চক্রান্ত আমার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। এ চক্রান্ত আমাদের আদর্শের বিরুদ্ধে। এই চক্রান্তের পেছনে কারা বোধহয় সেটাও খুঁজে বের করার সময় এসেছে। এ হত্যার চক্রান্তকারীদের বের করে জাতির সামনে তাদের চেহারা উন্মুক্ত করা দরকার। আমরা শেষ করে যেতে পারব কি-না? মনে করি একদিন না একদিন সেটা নিশ্চয়ই বের হবে। একদিন না একদিন নিশ্চয়ই প্রকাশ হবে। অবশ্যই এটা জাতিরও জানা দরকার। প্রজন্মের পর প্রজন্মের জানা দরকার। যে চক্রান্তটি আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল। নিশ্চয়ই সেটা জাতিকে জানতে হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই খুনের সাথে কারা জড়িত সেটা তো স্পষ্ট। তবে হ্যাঁ, জানি অনেক কিছুই কিন্তু... আমি তো বলেছি সব ব্যথা, সবকিছু ধারণ করেই যত শোক সব বুকে নিয়েই আমার পথ চলা। আমি তো নীলকণ্ঠ হয়ে বেঁচে আছি। আমি অনেক জানি বলতে পারব না, বলি না। কারণ আমার একটাই লক্ষ্য দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। এটা যখন স্বার্থকভাবে করতে পারব, তখনই আমার অনেক কিছু বলার সুযোগ আসবে।
দেশের মানুষের জন্য কাজ করার তাগাদা থেকেই ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এসেছিলেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাপ, মা, ভাই সব হারিয়ে কোথায় থাকব জানি না। কোনো চিন্তা করি নাই। আমার মনের ভেতরে একটা তাগাদা ছিল আমাকে ফিরতে হবে দেশে। আমাকে কিছু করতে হবে এই দেশের মানুষের জন্য। অন্যায়-অবিচার দূর করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। একদিকে খুনিদের বিচার, অপরদিকে শোষিত-বঞ্চিত মানুষগুলোর আমার পিতার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।
যাত্রাপথ সহজ ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বারবার আঘাত, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। আল্লাহ আমাকে এই শক্তি দিয়েছিল, আমার কোনো ভয় ছিল না। একটা আত্মবিশ্বাস ছিল মরতে তো একদিন হবেই। মরার আগে মরতে রাজি ছিলাম না। আমার সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি। ২০০৯ সাল থেকে পর পর তিনবার ক্ষমতায় থাকার ফলে আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।
সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য, যতই কাজ করি কিছু লোক তো পেছনে লেগে আছেই। তারা কিছুতেই ভালো দেখে না। একটা মিথ্যা অপপ্রচার চালাবেই তারা। যেখানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বার বার বলছে, না বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে নেই। সেখানে আমাদের দেশের কিছু মানুষ অপপ্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ যেখানে সারা বিশ্বের কাছে সম্মান পাচ্ছে, সেখানে আমাদের ভেতরের কিছু লোক বাংলাদেশকে অসম্মান করার জন্য মিথ্যা অপপ্রচার করে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধী ১৫ আগস্টের প্রেতাত্মারা যেন সক্রিয়।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আত্মস্বীকৃত খুনিদের মধ্যে যারা দেশে ছিল বিচার করেছি। আমরা তিনজনকে দেশের বাইরে থেকে আনতে পেরেছি। কর্নেল নুর কানাডায়, রাশেদ চৌধুরী আমেরিকায়, রশিদ লিবিয়া, পাকিস্তানেও থাকে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এরা আমাদের মানবাধিকারের কথা শোনায়। আর খুনিদের লালন-পালন করে। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য। তবে এ ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা রয়েছে।
জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দিয়েছেন মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি সকলকে নিয়ে রাজনীতি করে যাচ্ছি। আমি কারো বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নিতে যাইনি। আমি বিচারে বিশ্বাস করি। বিচারের মধ্য দিয়েই চলেছি। আমার ইচ্ছা প্রতিশোধ নেওয়া নয়, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাব। আমার বাবাকে হত্যা করে যে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে সেই মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন করা; তাদের জন্য সুন্দর জীবন দেওয়া; এটাই আমার লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। পরপর তিনবার ক্ষমতায় থাকার পর অন্তত কিছু কাজ করতে পেরেছি। এর সুফল দেশের মানুষ পাচ্ছে। দেশের মানুষ যাতে ভালো থাকে সেই ব্যবস্থাটা করার সুযোগ পেয়েছি। আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, পারতাম, কিন্তু করোনায় দুই বছরের ক্ষতি। তারপর এখন ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। এটাই আমাদের বাধা দিচ্ছে। জানিনা এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে।
এসআর/ওএফ