জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, সরকার জ্বালানি কূটনীতিতে মনোযোগী নয়। ওপেকভুক্ত বড় তেল উৎপাদনকারী কোম্পানি ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে জ্বালানি সরবরাহের স্থায়ী কোনো চুক্তির উদ্যোগ নেই। প্রাথমিক জ্বালানি, পরিকল্পনা জ্বালানি, নিরাপত্তা সরবরাহ নিশ্চিতের ধারণাই ছিল না সরকারের। বরং ছিল স্পট মার্কেট থেকে আমদানি প্রীতি। কারণ এটার মধ্যে অন্তর্নিহিত কোনো স্বার্থ আছে। প্রাথমিক জ্বালানির উৎস ও সরবরাহ নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) জাতীয় সংসদে করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সাম্প্রতিক সমস্যায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ জাতিকে জানাতে কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধির আওতায় আনিত সাধারণ প্রস্তাবের আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। প্রস্তাব উত্থাপন করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

প্রস্তাবের বিষয়ে মুজিবুল হক বলেন, সংসদের অভিমত এই যে, কোভিড-১৯, বৈশ্বিক অস্থিরতা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জ্বালানি সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রভৃতি সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী টেকসই পদক্ষেপসমূহ সংসদে আলোচনার মাধ্যমে জাতিকে অবহিত করা হোক।

বলা না কাওয়া নাই, এক লাফে ৪১ থেকে ৫১ শতাংশ ডিজেল, অকটেন ও পেট্রলের মূল্য বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে চু্ন্নু বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একক কোনো পণ্যের দাম এত বৃদ্ধি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এ কারণে সমস্ত জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। যার সঙ্গে তেলের কোনো সম্পর্ক নাই, সেই সমস্ত পণ্যও এই কালোবাজারি, অসৎ ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে দেখি না।

তিনি বলেন, সরকারের লোকেরা প্রত্যক্ষ করেন কিনা জানি না, কিন্তু আমরা দেখি মানুষ আসলেই খুব খারাপ অবস্থায়। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরীব মানুষ বাজারে গেলে তাদের গায়ে আগুন লেগে যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে।

তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্য পণ্যের মূল্য বাড়ার চিত্র সংসদে তুলে ধরে চুন্নু বলেন, এখনো পণ্যের দাম যে আরও বাড়বে না, তার কোনো ঠিক নাই। তেলের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সরকারের ব্যাখ্যার সমালোচনা করেন তিনি। সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম আরও সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত বলে দাবি করেন জাপার এই এমপি।

বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি জমা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ওই ব্যাংকগুলোর অবস্থা কাহিল। মানুষকে ঋণ দিয়ে তাদের এখন মূলধন নেই। বিপিসি চাইলেও টাকা ক্যাশ করতে পারবে না। বিপিসি কার স্বার্থে এই টাকা ওই সব ব্যাংকে রেখেছে, জানতে চান চুন্নু।

দেশে প্রতিবছরই বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়লেও বড় অংশ অলস পড়ে আছে দাবি করে চুন্নু বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রচুর আয় করেছে বিনিয়োগকারীরা। ১২ বছরের এখানে খরচ হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এমনকি ভারতে থেকে গত ৯ বছরে বিদ্যুৎ আমদানিতে ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা। ভর্তুকির পুরোটাই অপ্রয়োজনীয়, অলস, রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি ও ওভারহেডিং চার্জে গেছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা ঘোষিত উৎপাদনের অর্ধেকের কম দাবি করে তিনি বলেন, সরকার অর্থনীতির চালিকা শক্তি ডিজেল ও সারে ভর্তুকি দিতে অপারগ। অথচ অলৌকিকভাবে বিদ্যুতের বোঝা বাড়িয়ে চলছে কেন? বিগত এক যুগে শীর্ষ ১০ কোম্পানির ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৪৪ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। এ আনুকূল্যের পেছনের সরকারের স্বার্থ কী জানতে চান তিনি।

গত ছয় বছরে ৬২ হাজার কোটি টাকা বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কেন্দ্র ভাড়া দিচ্ছে সরকার। এসব কেন্দ্রের পূর্ণ সক্ষমতা দূরে থাক, ৩০ শতাংশ উৎপাদন সম্ভব হয়নি। অলস, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে অর্থ দিয়েছে কী কারণে?

ডিজেলের দাম কয়েক মাস আগে ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এখন আবার ৫১ শতাংশ। গত এক বছরে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। অথচ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে দুই শতাংশ জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। দেশের সেচ কেন্দ্রগুলোর ৩ ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ চালিত বাকি দুই ভাগ ডিজেল চালিত। ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষককে বাড়তি খরচ করতে হবে। এতে উৎপাদনের ঘাটতি হবে।

জ্বালানি তেলে দাম ৫ টাকা কমানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ কমাবেন। এটা কমাতে পারেন। এ সম্পর্কে একটি গল্প বলব, এক দেশে ছিল একটা রুটির দোকান, রুটির দাম ছিল ৫ টাকা। এই দাম দিয়ে রুটিওয়ালার পোষে না। তার সংসার চালাতে কষ্ট হয়। রুটিওয়ালা ১০ টাকা করার চেষ্টা করে। সেটা হলে দোকান চালানো সম্ভব। তিনি তখন রাজা মশাইয়ের কাছে গেলেন। তাকে ঘটনা খুলে বলার পরে রাজা বলল কী চাস? বলল ১০ টাকা হলে হয়। রাজা বললেন, তুই উজিরের কাছে যা। উজির কাছে গিয়ে ঘটনা বলার পরে তিনি বললেন, এটা কোনো সমস্যা নাকি? যা ১০ টাকা না, রুটির দাম ৩০ টাকা করা হলো।

এসআর/ওএফ