চারপাশটা সবুজে ঘেরা, কাঁচা রাস্তা ভাগ করেছে দুই পাশের বিস্তীর্ণ অংশকে। কোথাও আবার উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা টিলা। এখানে সবুজের সমারোহ দেখতে প্রতি বছরই অনেক ভ্রমণ পিপাসুরা ঘুরতে আসেন। কিন্তু তাদের অনেকেই জানেন না, পরতে পরতে সবুজ মাখানো এই বাগানের শ্রমিকদের নিদারুণ কষ্টের কথা। আধুনিক যুগে এসেও যারা মধ্যযুগীয় কায়দায় শোষণের শিকার। শ্রমিকের কান্না আর আহাজারি হয়তো ওপরের দরজায় পৌঁছায় না।

ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর বড় হয়ে বাবাকে হারিয়েছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানের শ্রমিক চান্দো ভূইয়া। ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। পরের বছর হয় প্রথম সন্তান। ১৯ বছর বয়সে তিনি চা-শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। ১৮ বছর ধরে ফিনলে কোম্পানির এই বাগানে কাজ করছেন তিনি।

স্বামী-সন্তানসহ সাতজনের পরিবার। তিন ছেলের বাইরে, বাকি দুজন শ্বশুর-শাশুড়ি। সংসারে অভাব ভুগিয়েছে ছেলেদের। আঠারো পার করা বড় ছেলে প্রাথমিকের গণ্ডিতেই থেমেছেন। মেজ ছেলে পড়েছেন প্রথম শ্রেণি পর্যন্তই। অবুঝ ছোট ছেলের জানা নেই, তার পড়াশোনা হবে কি-না। মাসের ২০ দিনই স্বামী থাকেন বেকার। বাকি দিনগুলোতে শহরে গিয়ে কামলা খাটেন।

>> চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ

প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের সদস্যদের জন্য পাতা শুকিয়ে বানানো লবণ চা, রেশন হিসেবে পাওয়া আটা দিয়ে বানানো রুটি আর চা-পাতার ভর্তা বানিয়ে রাখেন চান্দো ভূইয়া। ৮টার দিকে পুঁটলিতে চা, রুটি আর চা-পাতা ভর্তা বা চাল ভাজা নিয়ে চলে যান বাগানের গহীনে। মজুরির টাকা দিয়ে সংসার চলে না। তাই ওভারটাইম করেন। দুপুরে ঘরে খাওয়া হয় খুব কম। সঙ্গে নেওয়া খাবারের পুঁটলিটাই ভরসা। এই সময় কখনো তার স্বামী কাজে থাকেন, কখনো বা বাসায়। আর বড় ছেলের দায়িত্ব ছোটদের দেখভাল করা। কখনো আবার বাচ্চাদের সঙ্গে করেই নিয়ে যান।

তিনি জানান, তার বাগানে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে ২২ কেজি চা-পাতা তুলতে হবে। কিন্তু এর বিনিময়ে যে মজুরি পান, তাতে কিছুই হয় না। ধারদেনা করে চলতে হয়। এ কারণে ওভারটাইম করতে হয়। ওভারটাইম করে শেষ বিকেলে ঘরে ফেরেন। এরপর রাতের খাবারের বন্দোবস্তের পালা। আটা আর সেদ্ধ আলু ও চা-পাতা দিয়ে বানানো ভর্তাই ভরসা। ঘরে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি, সঙ্গে বাচ্চাদের বায়না, তাদের জন্য হলেও মাঝে মাঝে চাল কিনতেই হয়। যেদিন চাল কেনেন, সেদিন তিন ভাগ রাঁধেন আর এক ভাগ কলসিতে সঞ্চয় করেন। হঠাৎ কোনো আত্মীয়স্বজন এলে এই কলসিতে হাত পড়ে।
 
ভালো খাবার শেষ কবে খেয়েছেন প্রশ্ন করতেই চান্দো ভূইয়ার ফিকে হাসি। জানান, দুই মাস আগে সমাজী পূজা ছিল। সে সময় শ্রমিকপাড়ার সব ঘর থেকে চাঁদা তুলে সবাই মিলে মুরগির মাংস রান্না করে খাওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। এর বাইরে দুর্গাপূজায় খিচুড়ি আর অন্য পূজাগুলোতে দৈনিক রুটিনের বাইরে খাবার খাওয়া হয়। বিরিয়ানি, পোলাও চোখেও দেখেন না বলে জানালেন তিনি।

বাচ্চারা বায়না করছিল, তাই বুধবার ভাতিজার কাছ থেকে ২০ টাকা ধার নিয়ে কাচকি মাছ কিনেছেন। সেগুলোও সংখ্যায় হিসেব করা যাবে। আবার মাছেরও পচন ধরার মতো অবস্থা। চান্দো ভূইয়া বলেন, শ্রীমঙ্গল সদর থেকে মরা মাছ নিয়ে আসা হয়। আনতে আনতে সেগুলো অনেক সময় পচেও যায়। সে কারণে ৩০০ টাকার মাছ ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। আবার টাকার অভাবে সেটাও অনেকে কিনতে পারেন না।

তিনি জানান, আগে চাল দেওয়া হতো রেশন হিসেবে। ৪-৫ বছর ধরে সেটি বন্ধ হয়ে আছে। এখন আটা দেওয়া হয়।

>> ছোট্ট ঘরের এক পাশে গরু, অন্য পাশে চা-শ্রমিকের পরিবার

সবশেষ নতুন পোশাক কবে কিনেছেন জানতে চাইলে চান্দো ভূইয়া বুধবার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে টাকা মজুরি পাই তাতে নিজেদেরই পেট চলে না ঠিকমতো, নতুন পোশাক কিনব কীভাবে! তারপরও বাচ্চারা বায়না করে, ঘরে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি আছে। তাদের জন্য প্রতি বছর দুর্গাপূজায় নতুন পোশাক কেনার চেষ্টা করি। নতুন পোশাক আর কই! ওয়াশ করা কাপড়। সেটাই ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে কিনি। দুর্মূল্যের বাজারে এই টাকায় কত ভালো পোশাক পাওয়া যেতে পারে সেটা সবারই জানা। গত বছরের দূর্গাপূজায় কিনতে পেরেছি, এবার কি অবস্থা হবে জানি না।

চা পাতাকে বলা হয় গলানো সোনা। এই পাতার একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে। একটি গাছ থেকে একবার কচি পাতা তোলার পরবর্তী সাত থেকে নয় দিন ওই গাছ থেকে আর পাতা তোলা হয় না। তখন সেখানে নতুন কুঁড়ি ও পাতা আসে। নতুন পাতা আসার তিন দিনের মধ্যেই তা তুলতে হয়

চান্দো ভূইয়ার মতো প্রায় সব চা-শ্রমিকের জীবনই এমন করুণ গল্পে ভরা। তারা ক্ষুধা নিবারণ করেন লবণ-চা দিয়ে। তবে যাদের ঘরে চা-শ্রমিকের বাইরে অন্য পেশার কেউ আছে, যাদের ছেলেমেয়ে প্রবাসী শ্রমিক, তাদের অবস্থান অন্যদের চেয়ে কিছুটা ভালো।

>> ‘অভাবী’ শ্রমিকদের কাছে উন্নত চিকিৎসা যেন ‘বিলাসিতা’

শ্রমিকরা জানান, একটা চা গাছ থেকে ৬ মাস পর এক পাতি তোলা যায় আর দুই থেকে আড়াই বছরের মাথায় পুরো পাতি পাওয়া যায়। চা গাছ লাগানো থেকে শুরু করে পরিচর্যা, চা-পাতা তোলা, প্রক্রিয়াজাতকরণের সবকিছু শ্রমিকদেরই করতে হয়। কিন্তু তারপরও তাদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হয় না। বিভিন্ন নিয়মের গ্যাঁড়াকলে বিপর্যস্ত শ্রমিকদের জীবন।

শুধু হাড়ভাঙা খাটুনিই নয়, চা পাতা তোলার সময় তাদের কাঁধে ঝোলে বড় বস্তা। একজন কৃষি শ্রমিক দিনে ৭-৮ ঘণ্

টা পরিশ্রম করে। যারা ওভারটাইম করে, তাদের সময় আরও বেশি। চা-পাতা ও চা-শ্রমিকদের আরও কিছু বিষয় অনেকরই অজানা। 

তিন দিনের মধ্যে না তুললে অকেজো চা পাতা

চা পাতাকে বলা হয় গলানো সোনা। এই পাতার একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে। একটি গাছ থেকে একবার কচি পাতা তোলার পরবর্তী সাত থেকে নয় দিন ওই গাছ থেকে আর পাতা তোলা হয় না। তখন সেখানে নতুন কুঁড়ি ও পাতা আসে। নতুন পাতা আসার তিন দিনের মধ্যেই তা তুলতে হয়। একবার পাতা তোলাকে বলা হয় ‘এক রাউন্ড’। তখন দুই থেকে তিন কুঁড়ি পাতা তোলা যায়। পাতা বড় হয়ে গেলে সেটা আর কাজে আসে না। বড় পাতায় চায়ের মান ভালো থাকে না। সেজন্য অনেক সময় বাগান কর্তৃপক্ষ আর তোলেন না। কারণ তাদের দাবি, এতে তাদের উৎপাদন খরচও আসে না। ভরা মৌসুমে একদিন যদি চা তোলা বন্ধ থাকে, বাগান মালিকদের ক্ষতি হয় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা।

শ্রমিকদের কপালে জোটে না গুঁড়ো চা পাতা 

চান্দো ভূইয়া বলেন, আমরা চা পাতা তুলে কারখানায় পৌঁছে দেওয়ার পর সেই পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের পর গুঁড়া চা পাতা তৈরি হয়। কিন্তু কোনো শ্রমিক এই গুঁড়ো চা পাতা পায় না। এজন্য আমরা চা পাতা (কাঁচা চা-পাতা) তুলে সেগুলো রোদে শুকাই। এরপর সেগুলো দিয়ে লবণ চা বানিয়ে খাই। আবার পুরো কাজটাই করতে হয় মালিকপক্ষের অন্তরালে। তারা যদি দেখে কেউ চা পাতা নিয়েছে, তাহলে বকাঝকা করে।

মালিককে দেয় ১৮শ টাকার চা, শ্রমিক পায় ১২০ টাকা

একজন শ্রমিককে বাগান ভেদে ২২ থেকে ২৪ কেজি চা পাতা তুলতে হয়। মে থেকে আগস্ট এই চার মাস থাকে চা-পাতার ভরা মৌসুম। এ সময় অনেকেই এর চেয়ে বেশি চা-পাতা তোলেন ওভারটাইম হিসেবে।

তলবের দিন কেউ কোনো বিষয়ে অভিযোগ করলে তাকে চিহ্নিত করে রাখা হয়। পরবর্তীতে যেকোনো অজুহাতে তাকে চার্জশিট দেওয়া হয়। চার্জশিট হলো অনেকটা হলুদ কার্ডের মতো। এর মাধ্যমে সতর্ক করা হয় যে, কেউ যদি আবার একই ধরনের কাজ করে তবে তাকে বাগান থেকে বের করে দেওয়া হবে

শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৪ কেজি পাতা মেশিনে দিলে ৬ কেজির মতো গুঁড়া চা হয়। মালিকপক্ষ বলছে, তাদের খরচের চেয়ে চা পাতার দাম বেশি নয়। সে কারণে তারা লোকসানের দিকে যাচ্ছেন।
 
মহসিন টি হোল্ডিংয়ের (গোবিন্দ্রশ্রী চা বাগান) মালিক মহসিন মিয়া মধু ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন চায়ের কেজিতে ১৭০ টাকার কাছাকাছি খরচ হয়। আর বিক্রি হয় ১৭০-৮০ টাকায়।

কিন্তু চা ছাত্র সংসদের সভাপতি চম্পা নাইডু বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, এক কেজি চা পাতা ন্যূনতম ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। সে হিসেবে ৬ কেজি চা-পাতার দাম ১৮শ টাকা। সেখানে শ্রমিক পাচ্ছেন মাত্র ১২০ টাকা।

মালিক কাটে ৭ টাকা, শ্রমিককে দেন দেড় টাকা

বাগানে নির্দিষ্ট ওজনের কম-বেশি চা তুললে টাকা কেটে নেওয়া ও মজুরি দেওয়ার কার্যক্রম চালু আছে। এ ক্ষেত্রে মালিক আর শ্রমিকের জন্য ভিন্ন নিয়ম চালু আছে।

চা শ্রমিক কাজল রায় জানান, তার কর্মস্থল ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন করিমপুর চা বাগান। ২০ কেজির মানদণ্ডেই চা তুলতে হয়। কিন্তু বেশি তুললে প্রতি কেজিতে শ্রমিকদের দেওয়া হয় দেড় টাকা করে। আর কমের জন্য প্রতি কেজিতে কেটে নেওয়া হয় সাত টাকা করে।

বাগান ভেদে আবার ভিন্ন চিত্রও আছে। কালীঘাট চা-বাগানের শ্রমিক সঞ্জয় তাতি বলেন, কাগজে আছে ২২ কেজি চা পাতা তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের দিয়ে কখনও ২৪ কেজি বা তারও বেশি তোলা হয়। কিন্তু মজুরি দেয় ১২০ টাকা। সে হিসেবে এক কেজি পাতা তুললে ৫ টাকা পাই। এ টাকাতে অনেকেরই সংসার চলে না। তাই তারা ওভারটাইম করে। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজির জন্য দেওয়া হয় সাড়ে ৪ টাকা।

তলব অনেকের কাছেই আতঙ্কের

বাগানের শ্রমিকরা পুরো সপ্তাহে যে কাজ করে, তার মজুরি দেওয়া হয় সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে। এটাকে তলব বলা হয়। একেক বাগানের তলব সপ্তাহের একেক দিনে হয়। ওই দিন সব শ্রমিককে সিরিয়াল অনুযায়ী লাইনে দাঁড়িয়ে পুরো সপ্তাহের কাজের মজুরি নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে একপাশ থেকে শুধু মালিকপক্ষের লোককে দেখা যায়, টাকা নেওয়ার পর হিসেবে গোঁজামিল থাকলেও কিছু বলা যায় না।

চা বাগানে রোববার সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। কেউ যদি বাকি ৬ দিন কাজ করে, তাকে ১২০ টাকা দৈনিক ভিত্তিতে ৭ দিনের মজুরি দেওয়া হয়। তবে শ্রমিকদের অভিযোগ, কেউ ছয় দিন কাজ করলেও মালিকপক্ষ থেকে বলা হয় ৫ দিন কাজ করেছে। আবার যারা হিসেব বোঝে না, তাদের অনেককেই সাপ্তাহিক মজুরির ৮৪০ টাকার মধ্যে ৪০০-৫০০ টাকা দেয়। তারা মালিকপক্ষের সামনে কিছুই বলতে পারে না।

সতর্কীকরণ চার্জশিট 

চা শ্রমিকরা বলেন, তলবের দিন কেউ কোনো বিষয়ে অভিযোগ করলে তাকে চিহ্নিত করে রাখা হয়। পরবর্তীতে যেকোনো অজুহাতে তাকে চার্জশিট দেওয়া হয়। চার্জশিট হলো অনেকটা হলুদ কার্ডের মতো। এর মাধ্যমে সতর্ক করা হয় যে, কেউ যদি আবার একই ধরনের কাজ করে তবে তাকে বাগান থেকে বের করে দেওয়া হবে।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) শ্রীমঙ্গল এরিয়া কো-অর্ডিনেটর পারভেজ কাইরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শ্রমিকদের বেশিরভাগই বাংলা জানেন না ঠিক মতো। কিন্তু এসব চার্জশিট ইংরেজিতে হয়, যে শ্রমিকদের বোঝার সাধ্য নেই। তাদের এত কঠিন ইংরেজিতে চার্জশিট দেওয়া হয়, যাতে তারা ভয় পেয়ে মালিকপক্ষের বিপক্ষে না দাঁড়ান।

গরুর খোঁয়াড়

চা-শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই গরু-ছাগল লালন-পালন করেন। কোনো কারণে এসব পশু বাগানে গেলে মালিকপক্ষের খোঁয়াডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনতে বাগান ভেদে ১০০-৫০০ টাকা খরচ করতে হয় শ্রমিকদের।

জমি ইজারা নিলে কাটা হয় রেশন

কেউ যদি এক কেয়ার (এক কানি) জমিতে চাষাবাদ করেন, তবে তার কাছ থেকে প্রতিদিন ২ কেজি করে রেশন কেটে রাখা হয়।

২০ বছর ধরে ফিনলে চা-কোম্পানির অধীন কালীঘাট চা-বাগানে কাজ করেন খোকন চাষা। ৬ বছর বয়সী মেয়ে ও ৩ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে চারজনের পরিবার। নিজের ঘর নেই, তাই অন্যের ঘরে থাকেন। ঘরের জন্য আবেদন করেছেন, এখনো মালিকপক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। বাগানে কাজের পাশাপাশি ৩ কেয়ার জমিতে চাষাবাদ করেন।

খোকন চাষা বলেন, ৩ কেয়ার জমিতে ধান চাষ করি। সেজন্য কেয়ার প্রতি ২ কেজির বেশি রেশন কেটে রাখা হয়। সাড়ে ১০ কেজি আটা পাওয়ার কথা। সাড়ে ৭ কেজি কেটে ৩ কেজি দেয়।

চা শ্রমিকদের দৈনিক বাজার তালিকায় যা থাকে

চা-শ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রেই চা পাতার ভর্তার ওপর নির্ভরশীল। মজুরি কম, তাই একসঙ্গে বাজার করতে পারেন না। সেজন্য প্রতিদিনই অল্প পরিমাণে বাজার করেন তারা। এর মধ্যে শুকনা মরিচ, গুঁড়া মরিচ, হলুদ, মশলা, পেঁয়াজ, রসুন, মুড়ি, চানাচুর সবগুলো ৫ টাকা করে; ১০/১৫ টাকার তেল; প্রতিদিন না হলেও এক/দুই দিনে আলু। টাকা থাকলে ৫ টাকার কাঁচা মরিচ, এক কেজি চাল ও পুরো সপ্তাহের জন্য ২০ টাকার আধা কেজি লবণ।

এন্টাসিড, প্যারাসিটামল, ডাইক্লোফেনাক, ফ্ল্যাজিলের বাইরে ওষুধ পাওয়া যায় না। তাই উন্নত চিকিৎসা তাদের কাছে অনেকটা বিলাসিতার মতো

পড়াশোনার সুযোগ কম

দৈনিক মজুরি কম হওয়ায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় চা শ্রমিকের সন্তানরা। বাচ্চাদের ১৪/১৫ বছর বয়স থেকে কাজ শুরু করতে হয়। শ্রমিকরা বলছেন, বাচ্চাদের বেতন দিতে পারেন না, তাই স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়েছেন। সরকারি কিছু স্কুল হওয়ায় আগের চেয়ে প্রাথমিকে কিছুটা উন্নতি হলেও মাধ্যমিক থেকে উচ্চ শিক্ষায় বাজে অবস্থা চা শ্রমিক সন্তানদের।

চিকিৎসা সেবা মানে বিলাসিতা

অভাবের কারণে কোনো শ্রমিক গুরুতর অসুস্থ হলেও উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেন না। আবার মালিকপক্ষের ভরসায় চিকিৎসা করালেও তারা চিকিৎসার ব্যয়ের মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ বহন করেন। চা-বাগানের যে মেডিকেল সেন্টার রয়েছে সেখানে মেলে না যথাযথ চিকিৎসা। শ্রমিকরা বলছেন, এন্টাসিড, প্যারাসিটামল, ডাইক্লোফেনাক, ফ্ল্যাজিলের বাইরে ওষুধ পাওয়া যায় না। তাই উন্নত চিকিৎসা তাদের কাছে অনেকটা বিলাসিতার মতো।

ঋণ আর বাকিতে চলে সংসার

মজুরিতে সংসার চলে না চা শ্রমিকদের। সে কারণে এনজিও থেকে কিস্তি আর দোকানে বাকি করে চলতে হয় তাদের। কিস্তির ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ দিতে হয়। অনেকের পক্ষে মজুরির টাকায় কিস্তির টাকা শোধ করা যায় না। সেক্ষেত্রে তারা ঘরের গবাদি পশু বিক্রি করে দেন। আর দোকানের এক সপ্তাহের পাওনা টাকা পরের সপ্তাহে দেন। এতে অপারগ হলে পরের মাসে দেন।

ভাড়াউডা এলাকার দোকানদার অরুণ মাহালী বলেন, চা শ্রমিকরা তো পাড়াতেই থাকে। সে কারণে তাদের বিশ্বাস করে বাকি দেওয়া হয়। তারা সপ্তাহে না পারলে মাসে মাসে টাকা দিয়ে দেয়।

মাটির ঘরের ভাড়া আড়াই হাজার টাকা

৭ ফুট বাই ১৪ ফুট ঘরের এক পাশে ৫ জনের পরিবার, অন্যপাশে গবাদি পশু। এসব ঘরের কোনোটিতে খড়ের চালা, কোনোটায় টিন দেওয়া। ১০টা টিন নষ্টের পর নতুন টিনের জন্য আবেদন করলে ৩-৪টা টিন দেয় মালিকপক্ষ। এজন্য মালিকপক্ষের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ৬ মাস থেকে এক বছর চলে যায় শ্রমিকদের। সে কারণে অনেকেই ঋণ করে হলেও টিন লাগিয়ে ফেলেন।

মালিকপক্ষ বলছে, এসব ঘরের পেছনে তাদের প্রতিদিন ৭৬.৯২ টাকার ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সে হিসাবে মাসে আসে ২ হাজার ৩০৭ টাকা। কিন্তু  সাধারণ চা শ্রমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদ বলছে, দুর্গম অঞ্চলে মাটির তৈরি ঘরের এত ভাড়া হয় কীভাবে।

যাওয়ার জায়গা নেই, তাই বাধ্য হয়েই চা শ্রমিক

চা বাগানের শ্রমিকদের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। বাগানের কাছাকাছি জায়গায় মালিকপক্ষ ঘর করার জায়গা দেয়। সেই জায়গার জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি করা আছে মালিকপক্ষের। সেখানে থাকতে হলে ঘরের ন্যূনতম একজন সদস্য হলেও বাগানে কাজ করতে হবে। নইলে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। যাওয়ার জায়গা না থাকায় অনেকেই বাধ্য হয়ে চা শ্রমিকের কাজ করেন।

শ্রমিকরা আরও বলছেন, প্রতি ঘরে যতজন শ্রমিকই থাকুক না কেন, সেনসাসভুক্ত হবেন একজন। জনপ্রতি প্রতিদিন আধা কেজি ও বাচ্চাদের ২৫০ গ্রাম করে আটা দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটাও ঠিক মতো দেওয়া হয় না। আবার বাচ্চার বয়স ১২ বছর হলে তার জন্য আর রেশন দেওয়া হয় না। একটা ঘরের পুরুষ প্রধান শ্রমিক হলে পরিবারের সবাই চিকিৎসা সুবিধা পাবে। আর মহিলা প্রধান হলে কেউই পাবে না। দুই সন্তানের বেশি হলে বা সন্তানের বয়স ১২ পার হলে চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে শ্রীমঙ্গল বা মৌলভীবাজার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। না নিতে পারলে মারা যায়।

তারা বলছেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ব্যাংকে ম্যানেজারের অ্যাকাউন্টের রাখা হয়। সেখান থেকে মাসে মাসে টাকা পাওয়া যায়। আবার এগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার সময় টাকা কেটে রাখা হয়।

>> নতুন মজুরিতে খুশি চা-শ্রমিকরা, কাজে ফিরবেন রোববার

কালীঘাটের চা শ্রমিক ধীরেন তাত্ত্বিক বলেন, এটা ব্রিটিশ আর পাকিস্তানি আমলের মতো এক ধরনের দাস প্রথা ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা। শ্রমিকদের মালিকপক্ষ জিম্মি করে রাখে। তলবের দিন দাসের মতো আচরণ করে। কোনো অভিযোগ করতে গেলে এমনভাবে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয়, মনে হয় আমরা দাসপ্রথার যুগে আছি। তাদের কথা হলো, কাজ করতে পারলে থাকো, নয়তো এই এলাকা ছেড়ে চলে যাও। যাওয়ার জায়গা নেই, তাই বাধ্য হয়েই কাজ করতে হয়।

মালিকদের দাবি, দৈনিক মজুরির জন্য ৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। কারখানা ছাড়া অন্য পর্যায়ে কোনো শ্রমিক ২-৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করে না। ২২ কেজি চা পাতা তোলার নিয়ম ২০০ বছর আগে থেকে চলে আসছে। এই পরিমাণ চা পাতা তুলে একজন শ্রমিক ১২০ টাকা পাচ্ছে। এখন খুব সহজেই একজন শ্রমিক ৪০-৫০ কেজি চা পাতা তুলতে পারে। যখন সে ৪০ থেকে ৫০ কেজি চা পাতা তোলে তখন তার হাজিরা দুই থেকে তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে।

মহসিন টি হোল্ডিংয়ের (গোবিন্দ্রশ্রী চা বাগান) মালিক মহসিন মিয়া মধু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০ বছর আগে চায়ের কেজি যা ছিল আজকেও তাই। কিন্তু এই সময়ে শ্রমিকদের মজুরি ৭০ ভাগ বাড়ানো হয়েছে। এটা সবাইকে স্বীকার করতেই হবে যে, চা বিক্রি করে যে লাভ আসবে সেটা দিয়ে শ্রমিকদের বেতন, বাগানের খরচ সব কিছু দিয়েই বাগান চালাতে হবে। এখানে ভর্তুকি দেওয়ার সুযোগ নেই।

হামিদিয়া চা বাগানের মালিক অলিউর রহমান বলেন, খরচ বেশি, কিন্তু চায়ের দাম কম। দাম বাড়ালে ভারতীয় কম দামি চায়ে দেশের বাজার সয়লাব হবে, সেটা ভেবে এখনো বাগান করে যাচ্ছি। ৮ বছর ধরে চা বাগান করছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখিনি। বলা যায়, কিছু শ্রমিকের কর্মসংস্থান করতে পেরেছি। 

এএজে/এনএফ/ওএফ