পঞ্চম পর্ব-

গত তিন মাস ধরে বাংলাদেশে ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারছেন না রিয়াজ খান (ছদ্মনাম)। দেশে পরিবার-পরিজন কেমন আছেন, তা নিয়েও বেশ উদ্বিগ্ন। অনেকের ভিড়ে তিনিও দাঁড়িয়ে ছিলেন, যদি কেউ কাজে নেয়…

একসঙ্গে অনেক বাংলাদেশির জটলা। কেউ একা দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ বসা; আবার কেউ কেউ গল্প করছেন। পরনে কারও শার্ট-প্যান্ট, কেউ পরে আছেন লুঙ্গি। দেখতে অনেকটা বাজারের মতো।

স্থানটি পুরাতন দুবাইয়ের ডেরায় আল-নাকিলে। আল-আফিয়া কার্গোর পাশে পিরোজপুরা এলাকা নামেও চেনেন অনেকে। প্রতিদিন মাগরিবের পর এখানে জড়ো হন অসংখ্য বাংলাদেশি। তাদের লক্ষ্য দিনমজুরের কাজ পাওয়া। দুবাইয়ের প্রবাসীরা জায়গাটি মানুষ ‘কেনাবেচার বাজার’ বলেন।

আরও পড়ুন >> আছে আধিপত্য, নেই বাংলাদেশি ফল

সরেজমিন বাজারটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ লোক জড়ো হয়েছেন সেখানে। স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক, কন্ট্রাক্টর কিংবা ম্যানেজাররা আসেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা, দর-কষাকষি করেন। দুই পক্ষ দাম নিয়ে সন্তুষ্ট হলে কাজের চুক্তি করেন।

মূলত প্রতারণার শিকার বাংলাদেশিরা দৈনিক কাজের সন্ধানে এখানে বেশি আসেন

কারা, কেন আসেন এখানে

বাজারে আগতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে সাধারণত দুই ধরনের বাংলাদেশি প্রবাসীরা আসেন। অনেকে আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে দুবাইয়ে এসেছেন কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে সব হারিয়েছেন। এখানে এসে কোনো চাকরি পাননি। তারা প্রতিনিয়ত এ বাজারে আসেন। অনেকে আছেন যারা নিয়মিত চাকরি করছেন। শুক্র ও শনিবার তাদের ছুটির দিন। সেসব বাংলাদেশি ছুটির দিনে বাড়তি আয়ের জন্য কাজের খোঁজে এখানে আসেন।

একটি সুপারশপে কাজ করি। করোনার কারণে বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার উপার্জিত টাকায় পরিবার চলে। গত কয়েক মাস ধার করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছি। বর্তমান চাকরিতে একদিন হাফ ও একদিন ছুটি পাই। এসময় অন্যের হয়ে কাজ করি

রিয়াজ খান (ছদ্মনাম), দুবাই প্রবাসী

সাঈদুল আলম নামে এক প্রবাসী ঢাকা পোস্টকে জানান, তার বাসা সিলেটের হবিগঞ্জে। গত আট বছর ধরে এখানে একটি সুপারশপে কর্মরত। বাংলাদেশি টাকায় আয় প্রায় ৪৩ হাজার। থাকা-খাওয়া ও ইনস্যুরেন্স বাদে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা দেশে পাঠান। আরও পাঠালে ভালো, কারণ সেখানে বৃদ্ধ বাবা-মা, দুই বোন ও স্ত্রী-সন্তানের খরচ চালাতে আরও টাকার প্রয়োজন। সে কারণে একদিনের কাজের সন্ধানে এখানে আসা।

রাজমিস্ত্রি, যোগালি, মালির কাজ মেলে এ বাজারে, উপার্জনও বেশ। দৈনিক ১৫০০-২০০০ টাকা

আরও পড়ুন >> হার না মানা গল্পগুলো যখন স্বপ্ন দেখায়

‘সপ্তাহের শেষদিনে এখানে আসি। একদিনের জন্য কারও সঙ্গে চুক্তি করে কাজ করি। গত দুই সপ্তাহ ধরে একজনের বাসায় গিয়ে বাগান পরিষ্কারের কাজ করেছি। এতে ছুটির দিনেও ৭০ দিরহাম আয় হয়েছে (প্রায় দুই হাজার টাকা)। গত এক বছর ধরে মাসে অন্তত তিনদিন এ বাজারে আসি।’

আজহার উদ্দিন নামে বিক্রমপুরের এক প্রবাসী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটি মোবাইল ফোন এক্সেসরিজের দোকানে কাজ করি। করোনাকালীন প্রায় দুই মাসের বেশি লকডাউনে ঘরে বসে ছিলাম। দোকান খোলার পর টুরিস্টদের সংখ্যা কমে যায়। বিক্রিও কম। দোকানের মালিক পাকিস্তানি। লোকসানের মুখে দোকান ছেড়ে দেশে ফিরে গেছেন। চাকরিও চলে যায় আমার। খুব কষ্টে দিনপার হচ্ছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি এখানে একবার এসেছিলাম। এখান থেকে একটি মোবাইল কোম্পানির অফিসের গ্লাস পরিষ্কারের জন্য যাই। চারদিন সেখানে কাজ করে আজ আবারও এখানে আসা। দেখি কেউ কাজ দেয় কিনা।’

গত তিন মাস ধরে বাংলাদেশে ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারছেন না রিয়াজ খান (ছদ্মনাম)। দেশে পরিবার-পরিজন কেমন আছেন, তা নিয়েও বেশ উদ্বিগ্ন। অনেকের ভিড়ে তিনিও কাজের খোঁজে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

আরও পড়ুন >> যেখানে স্বপ্ন ঝরে অশ্রু হয়ে

‘এখানে আসার কারণ’ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী আর তিন মেয়ে নিয়ে আমার পরিবার। সঙ্গে বৃদ্ধ বাবাও আছেন। সবচেয়ে বড় মেয়ে ১৩ বছরের, ছোটটার চার বছর। একটি সুপারশপে কাজ করি। করোনার কারণে বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার উপার্জিত টাকায় পরিবার চলে। অন্যকোনো উৎস নেই। দেশে তীব্র অভাবের মধ্যে পড়েছে তারা। গত কয়েক মাস ধার করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছি। বর্তমান চাকরিতে একদিন হাফ ও একদিন ছুটি পাই। এসময় অন্যের হয়ে কাজ করি। কাজের সন্ধানে তাই এখানে আসা।

 প্রবাসে শ্রমের বাজারে বিক্রি হয়েও আক্ষেপ নেই। কারণ, আগে পরিবার-পরিজনের স্বাচ্ছন্দ্য

কবে, কখন বসে এ বাজার

ডেরা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন মাগরিবের নামাজের পর বসে এ বাজার। দুবাইয়ে বৃহস্পতিবার হাফ বেলা অফিস, শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি। তাই বৃহস্পতি ও শুক্রবার সন্ধ্যায় এখানে সবচেয়ে বেশি মানুষ জড়ো হন। মূলত রাত ৮টা পর্যন্ত তাদের ভিড় বেশি থাকে। ৮টার পর বাজারে বাংলাদেশির সংখ্যা কমতে থাকে। ১০টার দিকে মোটামুটি খালি হয়ে যায়। এ বাজারে আসা অধিকাংশ মানুষই সিলেট ও চট্টগ্রামের।
 
যেসব চাকরি মেলে এ বাজারে

আল-নাকিরের বাংলাদেশি কেনাবেচার এ বাজারে সাধারণত ভবন নির্মাণের রাজমিস্ত্রি, রঙমিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান, হামালি (যোগালি), মালি প্রভৃতি কাজ মেলে।

গত ১৩ বছর ধরে দুবাইয়ে বসবাসরত হামিদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই এ অবস্থা দেখছি। বাংলাদেশের অনেক মানুষ প্রতারিত হয়ে দুবাই আসেন। তারা কাজ পান না। দিনের পর দিন জমানো টাকা দিয়ে চলেন। মূলত এসব বাংলাদেশি এ বাজারে আসেন। দৈনিকভিত্তিতে কাজের চুক্তি করেন। এখানে মূলত দিনমজুরের কাজগুলো বেশি মেলে।’

করোনার কারণে চাকরিও চলে যায়। খুব কষ্টে দিনপার হচ্ছিল। এখানে এসে একটি কাজ পাই। একটি মোবাইল কোম্পানির অফিসের গ্লাস পরিষ্কারের জন্য যাই। চারদিন সেখানে কাজ করে আজ আবারও এখানে আসা। দেখি কেউ কাজ দেয় কিনা

আজহার উদ্দিন, দুবাই প্রবাসী

তিনি বলেন, অনেক নামীদামি প্রতিষ্ঠান তাদের কন্ট্রাক্টরদের এ বাজারে পাঠায়। তারা বাংলাদেশিদের নির্বাচন করে নিয়ে যায়। দৈনিক ৬০ থেকে ১২০ দিরহাম পর্যন্ত (বাংলাদেশি ১৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা) আয়ের সুযোগ আছে। ধরুন কারও বাসার পানির পাম্প নষ্ট অথবা বাগানবাড়ি নোঙরা হয়ে আছে। এসব কাজে তারা এখান থেকে বাংলাদেশিদের ভাড়া করে নিয়ে যান।

আরও পড়ুন >> জীবিত থাকলে রেমিট্যান্স যোদ্ধা, মারা গেলে বেওয়ারিশ

স্থানীয় একটি পারফিউম দোকানের ম্যানেজার আবু জুবায়ের (ভারতীয় নাগরিক)। এখানে এসেছেন সেলসম্যানের খোঁজে। তিনি বলেন, সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে দোকানে ক্রেতাদের বাড়তি চাপ থাকে। এজন্য আমরা মাসহিসাবে কয়েকজন কর্মী নিতে এসেছি।

তাদের বেতন বা মজুরি কেমন ধরা হবে— জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, কাউকে এক মাসের চুক্তিতে নিলে অর্থাৎ সপ্তাহে তার কাজ হবে দুদিন- শুক্র ও শনিবার। সেই হিসাবে মাসে আট থেকে নয়দিনের কাজ। বাঙালিদের মধ্যে যারা আরবি ও হিন্দি পারেন তাদের অগ্রাধিকার দেই। আকর্ষণীয় সম্মানীও দেয়া হয়। এছাড়া কেউ যদি ভালো দক্ষতা দেখান সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে তাকে আকর্ষণীয় বেতনে স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়।

বাংলাদেশিদের কেন পছন্দ— জবাবে তিনি বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বাংলাদেশিরা অত্যন্ত কর্মঠ ও সৎ। তাই যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের পরেই আমাদের পছন্দ বাংলাদেশিদের। প্রতিনিয়ত এখানে এসে আমরা বাংলাদেশিদের সঙ্গে কাজের চুক্তি করে থাকি।

এআর/এমএআর/