বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের চলমান ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। আর টাকার অভাবে এ প্রকল্পটির কাজের গতি কমে গেছে বলে জানিয়েছে এর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড। তাদের দাবি গত সাত মাসে প্রকল্পের কাজের বিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এখনও বকেয়া রয়েছে।

পদ্মা সেতুতে সরকারের বাস ও ট্রেন একইসঙ্গে চালুর পরিকল্পনা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে বিল না পাওয়ার কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রেলপথ স্থাপনের কাজ শেষ না-ও হতে পারে।

রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজনের কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এটি চায়নার জিটুজি অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও চায়নার। এখানে কাজের ওপর ভিত্তি করে ধাপে ধাপে বিল দেওয়া হয়। পরামর্শক সুপারিশ করে, কনসালটেন্ট কাজের মান দেখভাল করে, প্রকল্প পরিচালক এগুলো সমন্বয় করেন। তারা বলল, বিল পাননি। বিল পাবে, এটা তো চলমান প্রক্রিয়া।’

তবে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দীন এ চৌধুরী এ বিষয়ে মন্তব্য করতে নারাজ। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশি অর্থ পেতেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমে এমন তথ্য প্রচার করেছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। চীনের অর্থায়নে জি টু জি পদ্ধতিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে তার চেয়ে বেশি কাজ হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করতে সংশোধিত বাজেটে বাড়তি ১ হাজার ৮০১ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি চায়না রেলওয়ে গ্রুপের হয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ফোরথট পিআর নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) প্রতিষ্ঠানটি এ সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সরকার একইদিনে পদ্মা সেতু এবং এর রেলপথ চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু তহবিল সংকট গোটা প্রকল্পটির সুষ্ঠু বাস্তবায়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থের অপর্যাপ্ততাকে কেন্দ্র করে প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি) এখন সঠিক সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা নিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আরও জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য অগ্রিম বিল (মোবিলাইজেশন পেমেন্ট) পেয়েছিলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এরপর প্রতিবারই বিল পেতে অনেক বেশি সময় লেগেছে। যেমন গত বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের বিল জমা দেওয়া হয় ২৭ অক্টোবর। ব্যয়ের স্থানীয় অংশ রেল ছাড় করেনি। এজন্য চীনা অংশও পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনীয় নির্মাণ সামগ্রী কেনা, সহযোগী ঠিকাদার ও সরবরাহকারীদের সময় মতো পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না বলেও এতে জানানো হয়।

পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প

বাংলাদেশের নির্মাণ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সেতু প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু। বিশ্ব ব্যাংক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগেই দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল। সে অভিযোগ দেশে-বিদেশে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পরে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল করে বাংলাদেশের নিজ টাকায় এখন নির্মাণ হচ্ছে পদ্মা সেতু। ৬ দশমিক ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সবচেয়ে বড় সেতুটি নির্মাণে সরকারের ব্যয় হবে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

দোতলা এ সেতুর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। ২০২২ সালের জুনে সেতু দিয়ে একই সঙ্গে সড়ক যান ও ট্রেন চলাচল করবে- এ লক্ষ্য সামনে রেখে করোনাকালেও কাজ চলছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় প্রকল্প। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। তার মধ্যে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দেবে চীন। বাকি ১৮ হাজার ২১০ কোটি ৩১ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হবে। ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যশোর পর্যন্ত এ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে ঢাকা থেকে মাওয়া ও ভাঙ্গা অংশের কাজ শেষ হলে পদ্মা সেতুতে সড়ক পরিবহনের সঙ্গে ট্রেনও চলাচল করবে। এটি প্রধানমন্ত্রীর ১০টি মেগা প্রকল্পের মধ্যে একটি। গত জানুয়ারি পর্যন্ত পদ্মা সেতুর রেল প্রকল্পের মোট অগ্রগতি হয়েছে ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত অংশে কাজ হয়েছে ৬৫ শতাংশ।

২০১৬ সালে পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। এ প্রকল্পে প্রায় ৯০০ জন চীনা নাগরিক যুক্ত আছেন। আগামী জুনের মধ্যে চীন থেকে ভাঙ্গা-মাওয়া অগ্রাধিকার সেকশনের জন্য রেল, ফিটিংস, পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং, ব্রিজের গার্ডার ইত্যাদি আসার কথা রয়েছে।

পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে মাওয়া, ভাঙ্গা, নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত ২১৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা সিঙ্গেল লাইন ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাকে যুক্ত করবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে এ পথে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল বাড়বে। ঘুরপথে চলা মৈত্রী ট্রেনও এ সেতু দিয়ে সহজে চলাচল করতে পারবে। মোংলা বন্দরের সঙ্গে রেলপথে রাজধানীর সংযোগ হবে পদ্মা সেতু দিয়েই।

পিএসডি/এমএইচএস