চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করার দাবিতে টানা ৯ দিনের আন্দোলন শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে আগের মজুরিতেই তারা কাজে নামবেন। প্রশাসনের সঙ্গে রোববার (২১ আগস্ট) রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কলে শ্রমিক নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন। আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, দুর্গাপূজার আগেই চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর অনির্দিষ্টকালের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন শ্রমিকরা।

আন্দোলনের শুরু থেকে শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। শ্রমিকরাও তাদের নেতৃত্বে আন্দোলন করেছিল। তবে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর যে সিদ্ধান্ত এসেছে, তাতে পরিস্থিতি বদলে যায়। এখন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের কথায় আর মন গলছে না ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের।

যে কারণে সোমবার (২২ আগস্ট) শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়ায় অবস্থিত বালিশিরা ভ্যালীর আওতাধীন কালিঘাট চা বাগানে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতাকে মারধর করেন চা-শ্রমিকরা। কারণ, তিনি আন্দোলনরত শ্রমিকদের আন্দোলন স্থগিত করে কাজে ফিরতে অনুরোধ করেছেন। এছাড়া আরও কয়েকটি বাগানে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের শ্রমিকরা ধাওয়া দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

চা-শ্রমিকরা বলছেন, আগের মজুরিতেই যদি কাজ করব, তাহলে আন্দোলন করলাম কেন? তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি ঘোষণা ছাড়া কোনো নেতার কথা আমরা শুনব না।

আরও পড়ুন: চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতিকে শ্রমিকদের মারধর

কালিঘাট পঞ্চায়েত সভাপতি অবাং তাতি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তাদের নেতা বানিয়েছি। কিন্তু তারা যদি আমাদের সমস্যা না বোঝেন তাহলে তাদের নেতা থাকার দরকার নেই। আমাদের মাঠে নামিয়ে তারা উধাও হয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী টিভিতে এসে ৩০০ টাকা মজুরি হবে— এই ঘোষণা দিলে আমরা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াব। নয়ত আমাদের আন্দোলন চলবে।

এদিকে শ্রমিকদের আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। শ্রমিকদের ধাওয়া খেয়ে অনেকেই আড়ালে চলে গেছেন। অনেক নেতার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। অনেকের নম্বরে কল গেলেও ধরছেন না।

এমন কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে ঢাকা পোস্টের। তারা জানিয়েছেন, শ্রমিকদের এই আন্দোলনে এখন সরাসরি কেউ নেতৃত্ব দিচ্ছে না। শ্রমিকরাই জোট বেঁধে আন্দোলন করছে। সরকারি সিদ্ধান্ত তারা মানছে না। সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গেলে ধাওয়া করছে ইউনিয়নের নেতাদের। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ চেয়েছেন চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি উজ্জলা পানিকা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১২০ টাকা মজুরি আমরা মেনে কী করব, সাধারণ শ্রমিকরাই যদি না মানে। আন্দোলন আর আমাদের হাতে নেই, সাধারণ শ্রমিকরা মাঠে নেমে গেছে। আমাদের ইউনিয়নের নেতারা বিভিন্ন জায়গায় মারধরের শিকার হচ্ছেন। অনেক বাগানের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে শ্রমিকরা আটকে রেখেছে।

আরেক সহ-সভাপতি জেসমিন আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শুনেছি বিভিন্ন জায়গায় ইউনিয়নের নেতারা শ্রমিকদের বুঝিয়ে কাজে যোগ দিতে বলছেন, তাদেরই ধাওয়া দেওয়া হচ্ছে, মারধর করা হচ্ছে। আমরা কিন্তু বের হতে পারছি না। নিজ নিজ এলাকাতেই আছি। বের হলেই মার খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই চাপের কারণে লুকিয়ে আছি।

আরও পড়ুন: চা-শ্রমিকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার, আগের মজুরিতে কাজের সিদ্ধান্ত

তিনি বলেন, প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে চা শ্রমিকরা আগের ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করবে। আসছে দুর্গাপূজার আগে প্রধানমন্ত্রী ন্যায্য মজুরি ঘোষণা করবেন। চা-শ্রমিক ইউনিয়ন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাদের কাজে যোগদান করতে বলেছে। কিন্তু তাদের কথা হলো, চা-শ্রমিক ইউনিয়ন এই কথা ঘোষণা দেবে কেন? তারা এও বলছেন, আমরা তো প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে শুনিনি। প্রধানমন্ত্রী যা নির্ধারণ করে দেবেন, আমরা মেনে নেব। কিন্তু চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের কথা শুনব না।

তিনি আরও বলেন, শ্রমিকরা আমাদের কোনো কথাই শুনছে না। এমনকি ইউএনও, ওসি, ডিসির কথাও শুনছে না। একমাত্র উপায় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ, এছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়ে ১২০ টাকা করা হয়েছিল। তবে এই মজুরিতে তারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে দাবি জানিয়ে আসছেন, যাতে মজুরি ন্যূনতম ৩০০ টাকা করা হয়। বিষয়টি নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে সরকার ও শ্রমিক সংগঠনের একাধিক সভাও হয়েছিল।

সর্বশেষ গত জুনে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের বৈঠক হয়। সেখানে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব দেন শ্রমিক নেতারা। কিন্তু মালিকপক্ষ ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩৪ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়। যে কারণে শ্রমিক নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর আরও এক মাস পার হলেও মালিকপক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। এর প্রতিবাদে ৯-১২ আগস্ট টানা চার দিন প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ধর্মঘট পালন করা হয়। তারপরও মালিকপক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো কথা না বলায় দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ১৩ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের সব চা বাগানে শুরু হয় শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের পূর্ণদিবস কর্মবিরতি। এই কয়দিন ধরে চা-শ্রমিকরা বাগানে বাগানে মিছিল-মিটিং-সমাবেশ ছাড়াও সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেছেন।

আরও পড়ুন: চা-শ্রমিকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার, আগের মজুরিতে কাজের সিদ্ধান্ত

শনিবার (২০ আগস্ট) মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কার্যালয়ে চা-শ্রমিক ও সরকারের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৪৫ টাকা। এরপর চলমান কর্মবিরতি প্রত্যাহার করার কথা জানান চা-শ্রমিক নেতারা। কিন্তু সাধারণ চা-শ্রমিকদের তোপের মুখে পড়ে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে চা-শ্রমিক ইউনিয়ন।

সর্বশেষ রোববার (২১ আগস্ট) রাতে অনেকটা গোপনে চা-শ্রমিকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান। এসময় চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এই বৈঠক। এরপর শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রেখে ৯ দিনের আন্দোলন শেষে তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন এবং ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো হলো— প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে তার সম্মানে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ২২ আগস্ট থেকে কাজে যোগদান করবেন। আপাতত চলমান মজুরি অর্থাৎ ১২০ টাকা হারেই শ্রমিকরা কাজে যোগদান করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স পরবর্তীতে মজুরির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনার পর চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হবে বলে শ্রমিক নেতারা জানান।

তাছাড়া আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হওয়ার জন্য চা-শ্রমিক নেতারা আবেদন করবেন, যা জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপস্থাপিত হবে। চা-শ্রমিকদের অন্যান্য দাবিগুলো লিখিত আকারে জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করবেন। জেলা প্রশাসক প্রধানমন্ত্রীর সময় বিবেচনা জানাসহ তার কার্যালয়ে পাঠাবেন। বাগান মালিকরা বাগানের প্রচলিত প্রথা/দর মোতাবেক ধর্মঘটকালীন মজুরি শ্রমিকদের পরিশোধ করবেন।

তবে এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হয়েই এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন চা শ্রমিকরা।

এএজে/এসএসএইচ