হাতিরঝিল থানায় আসামির মৃত্যুর দায় আসলে কার?
রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় চুরির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সুমন শেখ নামে এক আসামির মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে দাবি করছে পুলিশ। তবে পুলিশের এ দাবি মানছে না ভুক্তভোগীর পরিবার। তাদের অভিযোগ, সুমনকে মেরে ফেলা হয়েছে। আত্মহত্যার কথা বলে পুলিশ দায় এড়াতে চেষ্টা করছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, হাজতখানায় থাকা আসামির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বা তাকে দেখভাল করে রাখার দায়িত্ব পুলিশের। সে ক্ষেত্রে হাজতে কোনো আসামির মৃত্যু হলে এর দায়ভার পুলিশকেই নিতে হবে। পুলিশের সাবেক এক আইজিপিও একইরকম বক্তব্য দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ হেফাজতে যদি কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এটির তদন্ত হওয়া উচিত। এটি যদি আত্মহত্যাও হয় তাহলেও পুলিশ তার দায় এড়াতে পারবে না। কারণ তাকে দেখে রাখাটা পুলিশের দায়িত্ব ছিল। পুলিশ হেফাজতে যেহেতু হাতিরঝিল থানায় ঘটনাটি ঘটেছে, তাই এই দায় তাদেরকেই নিতে হবে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাতিরঝিল থানার ঘটনায় পুলিশ যা বলছে, তা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এখানে দায়িত্বরতদের অবহেলা রয়েছে। হাজতের সামনে একজন সেন্ট্রি (রক্ষী) থাকেন, রাতে থানায় একজন ডিউটি অফিসারও থাকেন। এছাড়া হাজতে সিসিটিভি ক্যামেরাও লাগানো থাকে। রাতে দায়িত্বে যারা থাকেন, নিয়ম রয়েছে তারা হাজতে গিয়ে আসামিদের গতিবিধি খেয়াল করবেন। কিন্তু ঘটনার দিন হয়তো তারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পুলিশের উচিৎ তদন্ত করে আসামির মৃত্যুর আসল কারণ ও দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি বের করা।
সুমনের পরিবারকে কি মিথ্যা বলেছে পুলিশ?
সুমন শেখের পরিবারের দাবি, শুক্রবার বিকেলে সুমনকে গ্রেপ্তারের পর এক স্বজন শনিবার সকালে তার জন্য নাশতা নিয়ে যান। তখন পুলিশ ওই স্বজনের কাছ থেকে নাশতা বুঝে নেয় এবং দুপুরে সুমনকে আদালতে হাজির করা হবে বলে জানায়।
এখন সুমনের পরিবারের প্রশ্ন, যদি সুমনের মৃত্যু শুক্রবার রাতে হয়ে থাকে তাহলে পুলিশ কেন তার জন্য আনা নাশতা নিলো এবং আদালতে হাজির করার কথা বলল।
এ বিষয়ে সুমন শেখের স্ত্রী জান্নাত আক্তারের বড় ভাইয়ের স্ত্রী রুমা বেগম বলেন, সুমন কীভাবে মারা গেছে তা তো আমরা এখনো জানতে পারেনি। শনিবার সকালে পুলিশ বলল আদালতে হাজির করা হবে। আর বিকেলে বলল সে নাকি আগের রাতেই মারা গেছে। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই। জানতে চাই সুমন কি আসলেই আত্মহত্যা করেছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে।
শনিবার সকালের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, শনিবার সকাল ৯টায় আমার শাশুড়ি সুমনের জন্য নাশতা নিয়ে যান হাতিরঝিল থানায়। পুলিশ তার কাছ থেকে ১০০ টাকা ঘুষ নিয়ে ওই নাশতা গ্রহণ করে।
এরপর আমার শাশুড়ি পুলিশকে জানান সুমনকে তিনি দেখতে চান। তখন পুলিশ তাকে বলে, ‘আপনি থানার পাশে দাঁড়ান, একটু পরে সুমনকে আদালতে হাজির করার জন্য গাড়িতে তোলা হবে। তখন দেখতে পারবেন।’ সকাল ১০ টা পর্যন্ত আমার শাশুড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর পুলিশ এসে বলে, দুপুর সাড়ে ১২টায় সুমনকে আদালতে চালান করা হবে। সেখানে (আদালতে) চলে যান, দেখতে পারবেন।’ আমাদের প্রশ্ন রাত সাড়ে ৩টায় যে মানুষটা মারা গেছে বলে তারা এখন বলছে তাকে নিয়ে কেন এতো নাটক করল পুলিশ?
এ বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য জানতে একাধিকবার হাতিরঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ও পরিদর্শককে (তদন্ত) কল করলেও তারা রিসিভ করেননি। তবে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পরিবারের বক্তব্য মিথ্যা।
সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে সন্দিহান পরিবার
পুলিশ বলছে সুমন শেখ শুক্রবার রাতে যে আত্মহত্যা করেছে তা থানার সিসিটিভি ফুটেজে আছে। সুমনের পরিবারকেও ওই ফুটেজ দেখানো হয়েছে।
তবে আজ (রোববার) সুমনের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছেন, তবে সেই ব্যক্তি সুমন ছিলেন কি না তা তারা শনাক্ত করতে পারেননি।
এ বিষয়ে সুমন শেখের স্ত্রী জান্নাত আক্তারের বড় ভাইয়ের স্ত্রী রুমা বেগম বলেন, থানার ভেতরে আমাদের নিয়ে গিয়ে একটি সিসিটিভি ফুটেজ দেখিয়েছে পুলিশ। তবে আমরা নিশ্চিত নই, সিসিটিভি ফুটেজের ব্যক্তি সুমন ভাই কি না। তাছাড়া ফাঁস দিয়েছে এটা আমরা দেখিনি, একজন ব্যক্তি শুধু গ্রিল বেয়ে উঠেছে আর নেমেছে এটাই দেখেছি।
মামলা নিয়ে যা বলছে সুমনের পরিবার
নিহত সুমন শেখের বেয়াই মো.সোহেল আহমেদ বলেন, আজ সকালে সুমনের স্ত্রী আদালতে গিয়েছিলেন আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে। আইনজীবীদের পরামর্শ অনুযায়ী মামলা করা হতে পারে। এক্ষেত্রে ইউনিলিভার লিমিটেড বাংলাদেশ ও পুলিশের বিরুদ্ধে একটি মামলা করতে পারেন।
সুমনের স্বজন রুমা বেগম বলেন, যদি সুমনের মৃত্যুর সঠিক কারণ আমাদের না বলা হয়, তাহলে আমরা আদালতে মামলা করব। কেননা শুক্রবার বিকেলে সুমনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর যদি তিনি ওইদিন রাতে আত্মহত্যা করে থাকেন, তাহলে আমাদের কেন শনিবার সকালে আদালতে নিয়ে ঘোরানো হলো? সুমনের মৃত্যুর খবর আমরা কেন শনিবার সন্ধ্যায় জানতে পারলাম? সারা দিন তাহলে পুলিশ সুমনের মরদেহ নিয়ে কী করেছে? এ ছাড়া শনিবার সকালে ইউনিলিভারের ম্যানেজার মাসুদ আমাদের ফোন দিয়ে বলেন, তাকে পাঁচ লাখ টাকা দিলে নাকি সুমনকে পুলিশ ছেড়ে দেবে। কিন্তু সুমন তো শুক্রবার রাতেই মারা গেছেন। তাহলে সকালে পুলিশ তাকে কীভাবে জীবিত ছাড়বে? নিশ্চয়ই এখানে সুমনের সঙ্গে অন্যায় কিছু হয়েছে, এজন্যই তারা এত এলোমেলো তথ্য দিচ্ছে। আমরা এর সঠিক তদন্ত চাই। কেউ দায়ী থাকলে তার বিচার চাই। এজন্য আমরা মামলা করব এসব রহস্যময় কথার কারণ জানতে আমরা মামলা করব সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
সুমনের মৃত্যু নিয়ে কী বলছে পুলিশ
শনিবার রাতে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার আজিমুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ইউনিলিভার লিমিটেডের পিউরইটে চাকরি করতেন সুমন শেখ। পিউরইটের অফিসে ৫৩ লাখ টাকা চুরির ঘটনায় গত ১৫ আগস্ট একটি মামলা হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন আল আমিন, সোহেল রানা ও অনিক হোসেন। পরে এ তিনজনের দেওয়া তথ্য ও অফিসের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এ চুরির সঙ্গে সুমন শেখের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তাকে শুক্রবার বিকেলে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর সুমন শেখকে নিয়ে রাতে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে তিন লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টাকা জব্দ করা হয়।
তিনি বলেন, অভিযান শেষে সুমন শেখকে রাতে হাতিরঝিল থানায় রাখা হয়। শনিবার সকালে রিমান্ড আবেদন করে তাকে আদালতে হাজির করার কথা ছিল। কিন্তু শুক্রবার রাত ৩টা ৩২ মিনিটে সুমন তার পরনে থাকা ট্রাউজার দিয়ে গলায় ফাঁস নেন, যা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। এ ফুটেজ নিহতের স্ত্রীসহ স্বজনদেরও দেখানো হয়েছে।
আজিমুল হক বলেন, এ ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শনিবার রাতে দায়িত্বে থাকা ডিউটি অফিসার হেমায়েত হোসেন ও সেন্ট্রি মো. জাকারিয়াকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এদিকে, সুমনের মরদেহ হস্তান্তর নিয়ে পরিবারের দাবি, পুলিশ গ্রামের বাড়িতে দাফনের শর্তে মরদেহ দিতে চেয়েছে। ওই শর্তে রাজি না হওয়ায় মরদেহ দিচ্ছে না। তবে পুলিশ রোববার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, লাশ না নেওয়ার পেছনে কারো ইন্ধন রয়েছে। পরিবারের সদস্যরা অজানা কারণে লাশ নিতে বিলম্ব করছেন জানিয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার আজিমুল হক বলেন, এ বিষয়ে তারা রহস্য তৈরির চেষ্টা করছেন। পেছন থেকে কেউ ইন্ধন দিচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এমএসি/আরএইচ