জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ : ব্যাচেলেট
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বলেছেন, জটিল সমালোচনা সরকারকে প্রকৃত কারণ খুঁজতে এবং সমাধানে সহায়তা করে। মনে রাখতে হবে যে চলমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই হচ্ছে সফল হওয়ার প্রথম পথ। বাংলাদেশকে অগ্রগতির পরবর্তী ধাপে যাওয়ার আগে নাগরিক সমাজের সমালোচনাকে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য দুনীতি প্রতিরোধেও কাজ করতে হবে।
চারদিনের বাংলাদেশ সফরের কর্মসূচি শেষে বুধবার (১৭ আগস্ট) রাজধানীর একটি হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, বাংলাদেশে গুম, বিচারবর্হিভূত হত্যা, মানবাধিকার, নাগরিক সমাজের কথা বলার অধিকার নিয়ে উদ্বেগ আছে। এসব পরিস্থিতির উন্নতিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং নিরাপত্তা কৌশল পূর্ণগঠন করতে হবে। সামনের বছর নির্বাচন, এই সময়ে রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমসহ সবাইকে নিয়ে জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে অগ্রগতি করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি এবং সামাজিক খাতে যে উন্নতি করেছে সে বিষয়ে প্রশংসা করে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার বলেন, ঢাকায় এসে আমি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের চারজন মন্ত্রী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, মানবাধিকার কর্মী, কূটনৈতিক সম্প্রদায়সহ সবার সঙ্গে আলাপ করেছি। সমাজের সব স্তরের কথা আমি শুনেছি। নাগরিক সমাজ হচ্ছে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। জটিল সমালোচনা সরকারকে প্রকৃত কারণ খুঁজতে এবং সমাধানে সহায়তা করে। মনে রাখতে হবে যে চলমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই হচ্ছে সফল হওয়ার প্রথম পথ। বাংলাদেশকে অগ্রগতির পরবর্তী ধাপে যাওয়ার আগে নাগরিক সমাজের সমালোচনাকে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য দুর্নীতি প্রতিরোধেও কাজ করতে হবে।
আরও পড়ুন : আমাদের বিচার চাইতেও বাধা দেওয়া হয়েছে, ব্যাচেলেটকে প্রধানমন্ত্রী
নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন খুব কাছে চলে এসেছে, এ সময়ে নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর কথা বলার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে, কথা বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার অধিকার দিতে হবে, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সুরক্ষা দিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে, শক্তি প্রয়োগ না করে যাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সেজন্য তাদেরকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
মানবাধিকার হাইকমিশনার বলেন, সামাজিক অস্থিরতা নিরসনে এবং নাগরিক সমাজের অভিযোগ খণ্ডাতে নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহৎ পরিসরে সংলাপ হওয়া জরুরি। নারী সমাজ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং বিশেষ করে তরুণ সমাজের কথা শোনা জরুরি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সমাজের ওপর সহিংস কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ এবং তাদের বাড়ি-ঘর দখল করার বিষয়ে প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি আমি জোড় দিচ্ছি। ২৫ বছর আগে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন জরুরি।
ব্যাচেলেট বলেন, বাংলাদেশের একটি সলিড সাংবিধানিক কাঠামো আছে, যেখানে আইন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গিকার মেনে মানবাধিকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিশ্চয়তা দেওয়া আছে। যেখানে গুম থেকে সব নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে অঙ্গিকার ছাড়া জাতিসংঘের সব মানবাধিকার ইস্যুতে সম্মতি আছে, জাতিসংঘের গুম বিষয়ক অঙ্গীকারের সঙ্গেও সম্মতি প্রকাশ করতে আমি সরকারকে বলেছি।
তিনি বলেন, গুম (এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্স), বিচারবর্হিভূত হত্যা, নির্যাতন এবং র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কর্মকাণ্ড নিয়ে এবং এসব অভিযোগের জবাবদিহিতা নিয়ে জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটিসহ জাতিসংঘের একাধিক মানবাধিকার সংস্থা কয়েক বছর ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় আমি এসব গুরুতর অভিযোগ উল্লেখ করে বলেছি, নিরাপত্তা কৌশল পুনর্গঠন করে এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং স্বচ্ছ তদন্ত প্রয়োজন। বিভিন্ন মেয়াদে গুম এবং এসব বিষয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে চলা এবং সঠিক বিচারিক সুরক্ষার অভাব নিয়ে ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ আছে। এসব বিষয়ে সঠিক তদন্ত না হওয়া এবং বিচার পেতে বাধাগ্রস্ত হওয়া সমাজে দীর্ঘ মেয়াদে হতাশা সৃষ্টি করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক এই হাইকমিশনার বলেন, আমি সরকারকে প্রস্তাব করেছি যে একটি স্বাধীন এবং বিশেষ মেকানিজম তৈরি করতে যারা গুম ও বিচার বর্হিভূত হত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে এবং ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবার, নাগরিক সমাজের সঙ্গে কাজ করবে। এ বিষয়ে সরকারকে আন্তর্জাতিক মানের সহযোগিতা দিতে আমার অফিস (জাতিসংঘ) প্রস্তুত আছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের গুম সংক্রান্ত ওয়ার্কিং কমিটিকে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখার আমন্ত্রণ জানাতে পারে বাংলাদেশ। এতে এ ইস্যুতে সরকারের যে স্বদিচ্ছা আছে সেই অঙ্গিকার পূরণ হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ দেশের অভ্যন্তরীণ আইন সংস্কারের জন্যও আমি বলেছি।
আরও পড়ুন : ব্যাচেলেটকে মানবাধিকার নিয়ে অপপ্রচার সম্পর্কে জানালেন বিশিষ্টজনরা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ব্যাচেলেট বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের রিভিউ করতে সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা কাজ করছে। অনলাইনে ঘৃণার মন্তব্য ও সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে এবং অনলাইনে কথা বলার জন্য আরও বৃহৎ ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে আমি গুরুত্ব দিয়েছি। এ বিষয়ে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি।
তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাতিসংঘ সহায়তা করতে প্রস্তুত আছে। বাংলাদেশের উন্নতির পরবর্তী ধাপে পৌঁছাতে হলে টেকসই উন্নয়নের ১৬ নম্বর ধাপ অর্জন করতে হবে, যা মূলে রয়েছে সরকারের স্বাধীন সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করা এবং এরমধ্যে রয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, জাতীয় নির্বাচন কমিশন এবং বিচারিক ব্যবস্থা।
সাংবাদিকদের একাধিক প্রশ্নের জবাবে হাইকমিশনার বলেন, মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্বেগগুলো আমি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সকল স্তরের সঙ্গে আলোচনায় তুলেছি এবং এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করতে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতের কথা বলেছি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে তারাও বলেছে যে এখানে মানবাধিকার অধিকার নিয়ে কিছু ব্যত্যয় আছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে তারা জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং অভিযোগ খতিয়ে দেখতে যথাযথ ব্যবস্থা নিবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন এই আলাপকালে সরকারের পক্ষ থেকে হ্যাঁ সূচক মন্তব্য করা হয়েছে। আগামী বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশ সংক্রান্ত ইউপিআর (ইউনির্ভাসেল পিরিওডিক রিভিউ) বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে সরকারের আশ্বস্ত করা বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা বলা যাবে।
ব্যাচেলেট বলেন, ৭৪ সালে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। তারপরের বছর ৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাবাকে হারিয়েছেন। সুতরাং মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ব্যথা আমি বুঝি। আমি বিশ্বাস করি যে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে যে পরামর্শগুলো দেওয়া হয়েছে সরকার তা বাস্তবায়ন করবে। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি বিশ্বাস করি যে, যে কোনো সমস্যার সমাধান সংলাপের মাধ্যমে সম্ভব।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে হাইকমিশনার বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি অব্যাহত সমর্থন বজায় রাখতে এবং এ সংকট নিরসনে মিয়ানমারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে আমরা অব্যাহতভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে বলে যাচ্ছি। রোহিঙ্গা তহবিলের (জেআরপি- জয়েন্ট রেসপন্স প্লান) সংকট নিয়ে যে আলাপ আছে তা যেন বাস্তবে না ঘটে এজন্য আমরা প্রতিনিয়ত দাতা দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের একাধিক প্রতিনিধির সঙ্গে আমি আলাপ করেছি। তারা মিয়ানমারে তাদের বসত-ভিটায় ফিরতে আগ্রহী। কিন্তু মিয়ানমারে ফেরার মত ইতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। এমন অবস্থায় তাদেরকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করলে হিতে বিপরীত হবে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আছে জানিয়ে ব্যাচেলেট বলেন, সেখানে নিরাপত্তা ঘাটতি থাকায় রোহিঙ্গা জনপ্রতিনিধি মুহিবুল্লাহসহ অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছেন। রোহিঙ্গা নারীরা আমাকে বলেছে যে সেখানে এতোটাই নিরাপত্তা উদ্বেগ যে তারা রাতের বেলায় টয়লেট যেতে ভয় পায়, কারণ কিডন্যাপের শিকার হতে পারে। সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে।
জাতিসংঘের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেট গত ১৪ আগস্ট চারদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। এ সফরে হাইকমিশনার প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, শিক্ষা ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, মানবাধিকার কর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। সফরের মাঝে তিনি রোহিঙ্গা সংকট পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে কক্সবাজারের একাধিক রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে হাইকমিশনার ব্যাচেলেটের সঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গুয়েন লইসসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
এনআই/আইএসএইচ