চতুর্থ পর্ব

একজন করছেন দোকানদারি, একজন ঘুমাচ্ছেন; কেউ আবার ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একদল গোল হয়ে খোশগল্পে মশগুল। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাইয়ের বুকে এমন একটি মার্কেট (বাজার), যেখানে সবাই কথা বলের বাংলায়। লুঙ্গি পরে ঘোরাঘুরি করেন। মার্কেটের দোকানমালিক, কর্মচারী, লোডার, ট্রাকচালক, ট্রলিম্যান, ইলেকট্রিশিয়ান— সবখানেই বাংলাদেশিদের বিচরণ।

দুবাই শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের আল-আওয়ির ফ্রুট অ্যান্ড ভেজিটেবল মার্কেট। মার্কেটের অধিকাংশ ব্যবসায়ী বাংলাদেশি। তারা একে ‘আবির মার্কেট’ বলেও ডাকেন।

মরুভূমির কারণে দুবাইয়ে ফল কিংবা সবজি কিছুই উৎপাদিত হয় না। তবে আশপাশের দেশগুলো থেকে আবিরের ব্যবসায়ীরা ফল ও সবজি আমদানি করে এখানে বিক্রি করেন। পৃথিবীতে যে ফলই উৎপাদিত হোক, সবার আগে তা পাওয়া যাবে আবির মার্কেটে।

আরও পড়ুন >> হার না মানা গল্পগুলো যখন স্বপ্ন দেখায়

গুরুত্বপূর্ণ এ মার্কেটের নিয়ন্ত্রকও বাংলাদেশিরা। মার্কেটের প্রায় ৮০ শতাংশ জনবলই বাংলাদেশি। বাকিরা বাংলাদেশিদের অধীনে কাজ করা ভারত বা পাকিস্তানপ্রবাসী

গোটা দুবাইয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মুখে একটাই কথা, আবির মার্কেটে যার দোকান আছে সে নাকি দুবাইয়ে বসবাসরত ধনী বাংলাদেশিদের একজন। গুরুত্বপূর্ণ এ মার্কেটের নিয়ন্ত্রকও বাংলাদেশিরা। মার্কেটের প্রায় ৮০ শতাংশ জনবলই বাংলাদেশি। বাকিরা বাংলাদেশিদের অধীনে কাজ করা ভারত বা পাকিস্তানপ্রবাসী।

পৃথিবীর এমন কোনো ফল বা সবজি নেই যা এখানে পাওয়া যায় না, শুধু বাংলাদেশি পণ্য ছাড়া 

বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন করোনার প্রভাব, সর্বত্র যখন মন্দাভাব; তখন এর প্রভাব পড়ে আবির মার্কেটেও। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য। তারপরও আবিরের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে না ফিরে কোনোমতে টিকে ছিলেন দুবাইয়ে। এরপর লকডাউন শেষ হতেই আগের মতো তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন মার্কেটটি।

সবাই বলে বাংলাদেশিরা চাকরির জন্য প্রবাসে ঘুরে বেড়ান। অথচ এ মার্কেটে বাংলাদেশিরা ভারত ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের প্রবাসীদের চাকরি দেন

আমিনুর রহমান, ব্যবসায়ী, আবির মার্কেট

মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, এখানে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ধরনের ফল আর ৩০০ থেকে ৪০০ ধরনের সবজি পাওয়া যায়। ফলগুলো আসে ভারত, পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। এখান থেকে আবার সৌদি আরব, বাহরাইন, থাইল্যান্ড, মিশর, সিরিয়া, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ফল রপ্তানি হয়। আবার দুবাইয়ের ব্যবসায়ীরাও এখান থেকে ফল কিনে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সুস্বাদু ফলের জন্য বিখ্যাত বাংলাদেশ, অথচ বাংলাদেশি কোনো ফল নেই এ মার্কেটে।

আরও পড়ুন >> যেখানে স্বপ্ন ঝরে অশ্রু হয়ে

প্রবাসীরা জানান, এ মার্কেটে কাজ করার জন্য ভিসা নিতে হয়। মার্কেটের নাম ‘আব্দুল্লাহ আল খাত্তাল’ বলে সবাই এ ভিসাকে ‘আব্দুল্লাহ আল খাত্তাল ভিসা’ বলেন। অত্যন্ত দামি এ ভিসা। এটি লাগাতে প্রায় ৩৫ হাজার দিরহাম অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় নয় লাখ টাকা লাগে। অল্প সময়ে টাকাও উঠে আসে। এখানে কাজ করে সবাই খুশি।

আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশ থেকেও ফল আসুক। কিন্তু অতিরিক্ত খরচ আর নানাপর্যায়ে হয়রানির কারণে বাংলাদেশের ফল আনতে পারি না

জাহাঙ্গীর আলম, ব্যবসায়ী, আবির মার্কেট

আমিনুর রহমান নামে আবিরের এক ব্যবসায়ী বলেন, সবাই বলে বাংলাদেশিরা চাকরির জন্য প্রবাসে ঘুরে বেড়ান। অথচ এ মার্কেটে বাংলাদেশিরা ভারত ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের প্রবাসীদের চাকরি দেন। এখানে যারাই কাজ করেন তারা দেশে ও দুবাইয়ে অনেক ভালোভাবে জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশিদের সরলতা ও সততার ওপর আস্থা রাখছেন। তাই তারা এ মার্কেট থেকে বেশি বেশি ফল কিনে নিয়ে যান। এ কারণেই মার্কেটটি বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণে।

পুরো মার্কেটের দায়িত্বে আছেন বাংলাদেশিরা, তাদের অধীনে কাজ করেন ভারতীয়, পাকিস্তানিরাও

এমনিতেই বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণে আসেনি মার্কেটটি— চট্টগ্রামের বাবুল সরদার ঢাকা পোস্টের কাছে এর ব্যাখ্যা দিলেন। বলেন, বাংলাদেশে ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই আবির মার্কেটে বাংলাদেশিরা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, অনেক সময় এর চেয়েও বেশি গরমের মধ্যে কাজ করেন।

আরও পড়ুন >> জীবিত থাকলে রেমিট্যান্স যোদ্ধা, মারা গেলে বেওয়ারিশ

ফেনীর ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, এখানে প্রতিদিন ১৫০ কন্টেইনার মাল লোড-আনলোড হয়। বাংলাদেশিরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এখানে কাজ করেন। একমাত্র পরিশ্রমের কারণেই বাংলাদেশিরা এখানে টিকে আছেন।

আবিরের ব্যবসায়ীরা অনেক কাঁচা টাকার মালিক। দেশে পাঠানোর পরও অনেক টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। সেই টাকা দিয়ে তারা বাংলাদেশি মালিকানার বার ও ক্লাবগুলোতে আড্ডা জমান। বাংলাদেশি মেয়েদের মুজরা দেখেন

বাংলাদেশ থেকে ফল আমদানি না করার বিষয়ে এখনকার ব্যবসায়ীরা জানান, দুবাইয়ে ফল আমদানির অন্যতম শর্ত হচ্ছে ফলে কোনো ধরনের প্রিজারভেটিভ বা কেমিক্যাল মেশানো যাবে না। ফল থাকবে একদম টাটকা। বাংলাদেশ থেকে ফল আসতে অন্যান্য দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লাগে। পাশাপাশি পরিবহন খরচও বেশি। এ কারণে তারা বাংলাদেশি ফল আমদানি করেন না।

শ্রমের মূল্য এখানে বেশ, মাসে আয় ৬০-৭০ হাজার টাকা। দেশে টাকা পাঠিয়েও অনেকে আড্ডা জমান বার-ক্লাবেও

জাহাঙ্গীর আলম নামের অপর এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বলেন, এখানকার অধিকাংশ ফলই চীনসহ এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসে। আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশ থেকেও ফল আসুক। কিন্তু অতিরিক্ত খরচ আর নানাপর্যায়ে হয়রানির কারণে বাংলাদেশের ফল আনতে পারি না। সরকার যদি চায় তাহলে আমাদের অল্প খরচে বাংলাদেশি ফল আমদানির সুযোগ দিতে পারে। এতে দেশ লাভবান হবে। ইউএইতে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও সুনাম আরও বৃদ্ধি পাবে।

বার-নাইট ক্লাবে অধিকাংশই গ্রাহকই আবিরের ব্যবসায়ী

দুবাইয়ের ডেরায় অবস্থিত অধিকাংশ বার ও নাইট ক্লাবের গ্রাহক আবিরের ব্যবসায়ী। পুরাতন দুবাইয়ের এক ট্রাভেল এজেন্সির মালিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, আবিরের ব্যবসায়ীরা অনেক কাঁচা টাকার মালিক। দেশে পাঠানোর পরও অনেক টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। সেই টাকা দিয়ে তারা বাংলাদেশি মালিকানার বার ও ক্লাবগুলোতে আড্ডা জমান। ক্লাবগুলোতে বাংলাদেশি মেয়েদের মুজরা (নৃত্যগীতের প্রদর্শন) দেখেন।

বাংলাদেশে থাকলে হয়তো আমাকেও বাবার মতো ৫০০ টাকার দিনমজুরের কাজ করতে হতো। দুবাই এসে জীবনটাই বদলে গেছে

নাসির, ট্রলিম্যান, আবির মার্কেট

শুধু ব্যবসায়ীরা নন, আবির মার্কেটের লোডার, ট্রলিম্যানসহ সব পেশার মানুষই অনেক টাকা আয় করেন। রাতে আড্ডা দেন স্থানীয় এসব বার ও ক্লাবে।

দুবাই এসে যেন জীবনটাই বদলে গেছে, জানান এখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা

আবির মার্কেটে ট্রলিম্যান হিসেবে কাজ করেন ফেনীর নাসির। মাসে প্রায় ৭০ হাজার টাকা আয় করেন এই যুবক। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, তার বাবা বাংলাদেশে কৃষিকাজ করেন। তিন বছর আগে এখানে আসেন। বাবা অন্যের জমিতে কাজ করে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন। অভাবের সংসারে পড়াশোনা করতে না পারায় তারও বাবার পেশায় আসার কথা ছিল। কিন্তু সহায় আল্লাহ, প্রবাসে আসায় পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন।

নাসির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশে শিক্ষার অনেক দাম। পড়াশোনা না করলে কেউ চাকরি দেয় না, কেউ ভালো চোখে দেখে না, ভালো বেতন পাওয়া যায় না। সারাজীবন মানুষের শোষণে থাকতে হয়। এখানে আমরা যারা আছি, আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকতে পারে, তবে কাজের দক্ষতার কারণে আল্লাহর রহমতে অনেক টাকা উপার্জন করছি। বাংলাদেশে থাকলে হয়তো আমাকেও বাবার মতো ৫০০ টাকার দিনমজুরের কাজ করতে হতো। দুবাই এসে জীবনটাই বদলে গেছে।’

এআর/এমএআর/