মোবাইলে জিনের বাদশাহর প্রেম-বিয়ে, পরে স্ত্রীর হাতেই খুন
জিনের বাদশাহ পরিচয়ে প্রতারণাই পেশা ছিল জাকির হোসেন বাচ্চুর (৩৮)। প্রতারণার উদ্দেশ্যে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে আরজু আক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ফোনালাপ থেকেই তাদের প্রেম, এক পর্যায়ে বিয়ে।
বিয়ের পর আরজু আক্তারকেও প্রতারণায় সঙ্গী করেন বাচ্চু। আরজু আক্তারের সঙ্গে বসবাস করলেও পরকীয়ায় আসক্ত জাকির প্রতারণায় উপার্জিত সব অর্থ ব্যয় করতেন অনৈতিক কাজে।
বিজ্ঞাপন
এ নিয়ে মনোমালিন্য থেকে একপর্যায়ে আরজুকে তালাক দেন জিনের বাদশাহ পরিচয় দেওয়া বাচ্চু। তালাক হলেও তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতোই সম্পর্ক ছিল, প্রায়ই একসঙ্গে বসবাস করতেন। তবে পরকীয়া ও তালাকের প্রতিশোধ নিতে বাচ্চুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আরজু আক্তার।
পরিকল্পনা অনুযায়ী লঞ্চে ভোলা যাওয়ার পথে কেবিনে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বাচ্চুকে হত্যা করেন আরজু।
২৯ জুলাই সদরঘাট এলাকায় এমভি গ্রিন লাইন-৩ লঞ্চের স্টাফ কেবিন থেকে জাকির হোসেন বাচ্চুর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ৩১ জুলাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত বাচ্চুর প্রথম স্ত্রী সুরমা আক্তার।
১ আগস্ট মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তের ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) ভোরে সাভারের নবীনগর এলাকায় ঢাকাগামী একটি বাস থেকে আরজু আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ওই দিনই আদালতে আরজু আক্তার ১৬৪ ধারায় হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
বুধবার (৩ আগস্ট) রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান পিবিআই ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ খোরশেদ আলম।
তিনি বলেন, জাকির হোসেন বাচ্চুর বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দীনে। সেখানে তার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানরা থাকতেন। জিনের বাদশাহ পরিচয়ে প্রতারণা করে আসা বাচ্চু দুই বছর আগে একদিন কল দেন আরজু আক্তারকে।
জিনের বাদশাহ পরিচয়ে দেওয়া সেই কল থেকেই প্রেম। এরপর বিয়ে। ঢাকার একটি ভাড়া বাসায় দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুর সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন বাচ্চু। বিয়ের পর আরজু জানতে পারেন তিনি বাচ্চুর দ্বিতীয় স্ত্রী। এ ছাড়াও বাচ্চুর একাধিক পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়।
এ নিয়ে বিবাদের জেরে দুই মাস আগে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তালাক হলেও তারা একজন আরেকজনের বাসায় গিয়ে থাকতেন। তালাক দেওয়া ও একাধিক সম্পর্কের কারণে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন আরজু।
এর মধ্যে আরজু আক্তার জানতে পারেন ২৯ জুলাই বাচ্চু লঞ্চে ভোলায় গ্রামের বাড়ি যাবেন। আরজুর বাড়ি বাচ্চুর পাশের গ্রামে হওয়ায় কেবিন ভাড়া করে তাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেন আরজু। ওইদিন সকালে এমভি গ্রিন লাইন লঞ্চের একটি স্টাফ কেবিন ভাড়া করে দুইজন ভোলার উদ্দেশে রওনা দেন। লঞ্চে ওঠার আগে এক পাতা ঘুমের ওষুধ ও এক বোতল দুধ কিনে নেন আরজু।
পিবিআই এসপি বলেন, লঞ্চের কেবিনে প্রথমে তারা শারীরিক সম্পর্কে জড়ান। এরপর বাচ্চু পানি আনতে লঞ্চের নিচতলায় গেলে দুধের বোতলে পাঁচটি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রাখেন আরজু। কিছুক্ষণ পর বাচ্চু কেবিনে এলে তাকে ওষুধ মেশানো দুধ খেতে বলেন।
দুধ খেয়ে বাচ্চু ঘুমিয়ে পড়েন, এরপর তার হাত-পা ওড়না দিয়ে বেঁধে ফেলেন আরজু। এরপর আরেকটি ওড়না দিয়ে বাচ্চুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। হত্যার পর বাচ্চুকে কেবিনে স্টিলের খাটের নিচে লুকিয়ে রুমটি ভালোভাবে গুছিয়ে রাখেন আরজু।
লঞ্চটি ভোলার ইলশা ঘাটে পৌঁছলে আরজু নেমে যান। লঞ্চের ক্লিনার ওই কেবিনে এসে রুমটি গুছানো দেখে আর ভেতরে যাননি। দুপুরে লঞ্চটি আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে দুইজন মহিলা তিন বাচ্চাকে নিয়ে সেই কেবিনে ওঠেন।
এর মধ্যে একটি বাচ্চা খাটের নিচে গেলে এক মহিলা যাত্রী তাকে আনতে গিয়ে বাচ্চুর মরদেহ দেখতে পেয়ে লঞ্চের স্টাফদের খবর দেন। পরে স্টাফরা এসে মরদেহ দেখতে পেয়ে ঢাকার নৌ পুলিশকে খবর দেয়। লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছলে নৌ পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে। পরে পিবিআই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
পিবিআইয়ের এ কর্মকর্তা বলেন, মামলা হওয়ার পর পিবিআই, ঢাকা জেলা মামলাটির তদন্তভার নেয়। তদন্তের ধারাবাহিকতায় আরজু আক্তারকে শনাক্ত করা হয়। তদন্তে ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আরজু ভোলা নেমে স্পিডবোটে বরিশাল যান। সেখান থেকে বাসে দৌলতদিয়া হয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন। সাভারের নবীনগরে ঢাকাগামী বাস থেকে আরজু আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, লঞ্চের কেবিনে কোনো যাত্রী উঠলে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র রাখার কথা থাকলেও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বাচ্চু ও আরজুর কোনো পরিচয়পত্র রাখেনি। এ ছাড়া, তারা যে কেবিনটি ভাড়া দিয়েছিল সেটি ছিল স্টাফ কেবিন। স্টাফ কেবিন হওয়ার পরও তাদের কাছে অনৈতিকভাবে ভাড়া দেন লঞ্চের স্টাফরা।
জেইউ/আরএইচ