আর ১০টা সাধারণ দিনের মতোই ছিল ২১ জুলাই কারওয়ান বাজারের সন্ধ্যা। রাজধানীতে অহরহ ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ের মতো একটি ঘটনা ঘটে। তবে এরপরের ঘটনাক্রম প্রচলিত বৃত্তের বাইরে; যার ‘নায়ক’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারিশা আক্তার।  

পারিশার ফোনটি যখন ছিনতাই হয় তখন তিনি বাসে বসে ফোনে কথা বলছিলেন। হঠাৎ বাসের জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে কেউ তার মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে পারিশা বাস থেকে নেমে ছিনতাইকারীকে ধাওয়া দেন। সেই ছিনতাইকারী পালিয়ে গেলেও ধরে ফেলেন সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে। পারিশার বন্ধুরা ধরে ফেলেন আরেক সন্দেহভাজনকে। 

এই ঘটনার ভিডিও, বিশেষ করে পারিশা যেভাবে সন্দেহভাজন ওই ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করেছিলেন তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সাহসীকতার জন্য ব্যাপক প্রশংসিত হন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী পারিশা। আর ছিনতাইয়ের ঘটনার ১০ দিনের মাথায় পুলিশ মূল ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে, সঙ্গে উদ্ধার করেছে পারিশার পোকো এম থ্রি মোবাইল ফোনটিও। 
 
আজ বুধবার তেজগাঁও থানা প্রাঙ্গণে একটি সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে পুলিশ। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের পাশে ছিলেন পারিশাও।   

আসল ছিনতাইকারী পালিয়ে গেলেও পারিশা ধরে ফেলেন সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে

 

আরও পড়ুন : ছিনতাই করতেই খুন করা হয় শাবি শিক্ষার্থীকে

তিনি বলেন, আমি অনেক খুশি। পুলিশ খুব দ্রুত আমার মোবাইলটি উদ্ধার করেছে। সবচেয়ে খুশির কথা হচ্ছে ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করেছে। আমি বলব, এই ছিনতাইকারীরা যেন কোনোভাবে জামিনে ছাড়া না পায়, আবারও কেউ যাতে ছিনতাইয়ের শিকার না হয়।

নিজের সাহসিকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার সাহসিকতায় জনগণসহ সবাই সাহস দিয়েছেন। আমি চাই সবাই সবার বিপদে এগিয়ে আসুক। সবাই সাহসিকতার পরিচয় দিক। 

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের পাশে ছিলেন সাহসী তরুণী পারিশা আক্তারও

আপনার কেন মনে হলো ধাওয়া দিয়ে ছিনতাইকারীকে ধরা উচিত? একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার মোবাইলটি জানালা দিয়ে টান দিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বাস থেকে নেমে পড়ি। ছিনতাইকারীকে ধরার চেষ্টাও করি। কিন্তু সে দ্র্রুত আমার চোখের আড়ালে চলে যায়। আমি ইত্তেফাকের গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে সময় দু’জন ছেলে দৌড়ে আসে। ফোন ছিনতাই করে নিয়ে গেল বলাবলি করে আসছিল দুই ছেলে। আমার মোবাইলে বিগত এক বছরের থিসিসের সব ডাটা ছিল। সেদিনও নতুন ডাটা নিয়ে এসেছিলাম। মোবাইলটা আমার খুব দরকার ছিল। আমি খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার এটেনশন ছিল ছিনতাইকারীকে আমার ধরতেই হবে। ফোন ছিনতাইয়ের কথা বলাবলিতেই দৌড়ে যাই। একটু সামনে গিয়েই আমি একজনকে ধরে ফেলি। 

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানিয়েছে, এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় মূল অভিযুক্তের নাম আকাশ। ২১ জুলাই ঘটনার এক সপ্তাহ আগেই জামিনে বেরিয়েছিলেন তিনি। তাকেসহ আরও যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা হলেন- রাশেদুল ইসলাম (১৭) ও শফিক (২১)। এর মধ্যে শফিক ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে পারিশার ফোনটি কিনেছিলেন। 

আরও পড়ুন : সাহসী নারী পারিশাকে সম্মাননা দিল ইয়ামাহা রাইডারস ক্লাব

সংবাদ সম্মেলনে তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) রুবাইয়াত জামান বলেন, পারিশা দ্রুত বাস থেকে নেমে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ধরে ফেলেন। পারিশার সাথে থাকা তার বন্ধুরা ঘটনাস্থল থেকে অপর একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ধরে ফেলেন। সন্দেজভাজন দু’জন বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত থাকলেও পারিশার মোবাইল চুরির ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।  
 
এডিসি রুবাইয়াত বলেন, ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ এবং অপরাধীর বিষয়ে অভিযোগকারীর মৌখিক বর্ণনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয় অভিযুক্ত একজনকে। তার বয়স ১৮ বছরের নিচে। জিজ্ঞাসাবাদে সে ছাড়াও মূল অভিযুক্ত রিপন ওরফে আকাশের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। আকাশকে ধরতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আকাশ জেলে। পরে জিজ্ঞাসাবাদের স্বার্থে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে তাকে দু’দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়।

মাত্র চার হাজার টাকায় বিক্রি হয় পারিশার মোবাইল
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ ঘটনায় নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, ছিনতাই করা মোবাইল ফোনটি চার হাজার টাকায় শফিক নামে একজনের কাছে বিক্রি করা হয়।

তার দেওয়া তথ্য মতে, কারওয়ান বাজারে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় শফিককে এবং তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় পারিশার মোবাইলটি।

আকাশের নামে বিভিন্ন থানায় ৬ টি মামলা রয়েছে জানিয়ে এডিসি রুবাইয়াত বলেন, গ্রেপ্তার অপর অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু রাশেদের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা এবং চোরাই মোবাইল ক্রেতা শফিকের নামেও দুটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

পারিশার মোবাইল ফোনটি চার হাজার টাকায় শফিক নামে একজনের কাছে বিক্রি করা হয়।

পারিশা গুরুতর জখমের শিকার হতে পারতেন
পারিশার সাহসিকতার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে রুবাইয়াত জামান বলেন, পারিশা ও তার বন্ধুরা ব্যাপক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে এ ধরনের অপরাধীরা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। এক্ষেত্রে হয়তো পারিশা গুরুতর জখমের শিকার হতে পারতেন। তবে পারিশা চরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ছিনতাইকারীদের পোশাক, শারীরিক গঠন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন পুলিশকে। যা পুলিশের তদন্তে খুবই কাজে লেগেছে। আমরা পারিশার বিবরণী অনুযায়ী ছিনতাই করার সময়কার পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। 

আরও পড়ুন : স্বর্ণ ডাকাতিতে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তার দায় নেবে না বাহিনী : হারুন  

তেজগাঁও থানা এলাকায় আরও অনেক ছিনতাই হয়, পুলিশের ভূমিকা স্পষ্ট নয়, তাছাড়া ছিনতাইয়ের ঘটনায় অনেক ভুক্তভোগী মামলা করতে চান না, মামলা করতে গেলেও অনেক সময় পুলিশ মামলা নেয় না। শুধু ভাইরাল হলেই মোবাইল উদ্ধার হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে তেজগাঁও জোনের এ অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, পারিশা আমাদের অনেক সহযোগীতা করেছেন। তিনি জিডির পর মামলা করেছেন। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন। গ্রেপ্তারদের প্রত্যেকের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। এই ছিনতাইয়ে প্রধান জড়িত আকাশ গত ১৪ জুলাই অন্য একটি মামলায় মাত্র জামিনে বেরিয়েছিলেন। এটাই একটা সমস্যা যে, জামিনে বেরিয়ে আবারও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা তেজগাঁও এলাকাতেই গত জুলাইয়ে অন্তত ৫০টি মোবাইল উদ্ধার করেছি। ৩০ জনের মতো গ্রেপ্তার করেছি। এরমধ্যে ৭টি মামলার বাদী কিন্তু পুলিশই।

জেইউ/এনএফ