ডি-৮ সম্মেলন
হিনার সফর বাতিল নিয়ে অন্য কিছু ‘ভাবছে’ না ঢাকা
ডি-৮ সম্মেলন উপলক্ষে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার শেষ সময়ে ঢাকা সফর বাতিলের বিষয়টি নিয়ে অন্য কিছু ‘ভাবছে’ না ঢাকা। বরং ইসলামাবাদ সম্মেলনকে গুরত্ব দিচ্ছে বলে প্রতিমন্ত্রীর বদলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি নিজেই ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন বলে মনে করছে ঢাকা।
উন্নয়নশীল আট দেশের জোট ডি-৮ এর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন বুধবার (২৭ জুলাই) ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি ২০তম ডি-৮ মন্ত্রী পর্যায়ের এ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিজ্ঞাপন
সম্মেলনে যোগ দিতে আট সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আবদুল্লাহিয়ান এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে তারা সফর বাতিল করেন। তবে আমির-আবদুল্লাহিয়ান সফর বাতিল নিয়ে খুব একটা আলোচনা না হলেও হিনা রব্বানির বিষয়টি আসে আলোচনার মূল কেন্দ্রে।
আরও পড়ুন>> ঢাকায় আসছেন না হিনা রব্বানি খার
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার সঙ্গে পাকিস্তানের পতাকা জুড়ে দিয়ে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন ফেসবুকে যে ছবি প্রকাশ করেছিল, সে বিষয়ে ঢাকায় যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে; তাতে ‘বিব্রতকর পরিস্থিতি’ এড়াতে হয়তো হিনার ঢাকা সফর বাতিল করেছে ইসলামাবাদ।
তবে পাকিস্তানের প্রতিমন্ত্রীর ঢাকা সফর বাতিলের কারণ হিসেবে পতাকা ইস্যু কি না-তা বলতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপনারা (গণমাধ্যম) যেভাবে তাদের ধরেছেন, তারা তো বিব্রত অবস্থায় পড়েছে। তবে তাদের (পাকিস্তানের) প্রতিমন্ত্রী পতাকা ইস্যুর কারণে সফর বাতিল করেছেন কি না-সেটা আমি বলতে পারব না। যাই হোক তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভার্চুয়ালি সম্মেলনে যোগ দেবেন। তারা এ সম্মেলনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন। এটা নিয়ে আমরা অন্য কিছু ভাবছি না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দুনিয়ার সব দেশের পতাকাই তারা আপলোড করেছে, বন্ধু দেশগুলোর পতাকা। ওরা আমাদের দেখিয়েছে বন্ধু দেশ শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সবগুলো দেশের সঙ্গে তাদের পতাকা মেলানো। সেজন্য তারা বাংলাদেশেরটা মিলিয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে এত উত্তেজনায় তারা শেষে ডিলিট করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, এটা একটা নরমাল ইস্যু ছিল। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে, পাকিস্তান হওয়ায় সবাই অন্য রকমভাবে চিন্তা-ভাবনা করে।
গত বছরের ডিসেম্বরে পাকিস্তানে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মন্ত্রী পর্যায়ের জরুরি বৈঠকে অংশ নিতে যাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের। কিন্তু শেষ সময়ে তিনি সফরটি বাতিল করেন। তার বদলে সেখানে পাঠানো হয় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে। এছাড়া চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে দুই দিনব্যাপী ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৮তম অধিবেশনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি দেশটি সফরে যাননি। সেখানেও পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনকে পাঠায় ঢাকা।
ইসলামাবাদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী সফরে না যাওয়ার কারণে পাকিস্তান ডি-৮ সম্মেলনে শেষ সময়ে হিনার সফর বাতিল করে প্রতিশোধ নিলো কি না-জানতে চাইলে ড. মোমেন বলেন, এটা আমি মনে করি না। এমন হলে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভার্চুয়ালিও যোগ দিত না।
একই ভাষ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামসেরও। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রীর পাকিস্তানে সফরে না যাওয়া বা পতাকা ইস্যুতে পাকিস্তান তাদের প্রতিমন্ত্রীর সফর বাতিল করেছে বলে আমি মনে করি না। আসলে আমার মনে হয়, যেহেতু অন্য দেশ থেকেও মন্ত্রীরা শেষ পর্যন্ত আসছেন না, তাই তারাও হয়তো চিন্তা করে দেখল ওরা যাচ্ছে না; আমরাও গেলাম না। কারণ ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়ার সুযোগ তো রয়েছে।
২০১২ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা সফরে আসেন হিনা রব্বানি। সে সময় ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিলেন তিনি। এরপর প্রায় ১০ বছর পাকিস্তানের কোনো মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেননি।
হিনা রব্বানির সফর বাতিল করার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমার মনে হয় না এটার সঙ্গে অন্য সমীকরণ মেলানো ঠিক হবে। আমার যেটা মনে হয়, তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যোগ দেবেন ভার্চুয়ালি। যার আসার কথা ছিল সে তো পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। যদি অন্য কিছুই হতো বিলাওয়ালের তো থাকার কথা না। তিনি কিন্তু ভার্চুয়ালি এ সম্মেলনে যোগ দেবেন।
আন্তর্জাতিক এ বিশ্লেষক বলেন, আমার যেটা মনে হয়, পাকিস্তান চাইলে তাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ভার্চুয়ালি রাখতে পারতো। তা না করে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকছেন। তারা মনে করছে ডি-৮ এর একটা বড় ইমপ্যাক্ট ফেলার সুযোগ এসেছে, বিশেষ করে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই থাকছেন। এতে করে আরও গুরত্ব বাড়ছে বলে আমি মনে করি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ডি-৮ মন্ত্রীদের এ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আবদুল্লাহিয়ান এবং তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলিত সাভাসগলু ভার্চুয়ালি সম্মেলনে যোগ দেবেন। অন্যদিকে অন্য সদস্য রাষ্ট্র মিশর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং নাইজেরিয়ার উপ-মন্ত্রীরা ঢাকায় সশরীরে সম্মেলনে নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের সম্মেলনে খাদ্য ও জ্বালানি-নিরাপত্তা বিশেষ গুরুত্ব পাবে। পাশাপাশি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ানো নিয়েও আলোচনা থাকবে।
গত রোববার (২৪ জুলাই) ডি-৮ মন্ত্রী পর্যায়ের এ সম্মেলনের আলোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছিলেন, জ্বালানি ও খাদ্যনিরাপত্তা একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা বৈঠকে আলোচনা করা হবে। কারণ এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতার অনেক সুযোগ রয়েছে। আমরা খাদ্যনিরাপত্তাকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছি। খাদ্যনিরাপত্তা ইস্যু ব্যাপকভাবে আলোচিত হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার বিষয়ে ড. মোমেন বলেছিলেন, এটি সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে এবং এটি বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত বিষয়। আমাদের অবশ্যই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিয়েও আলোচনা হবে।
ডি-৮ জোটের সদস্য হওয়ার জন্য আজারবাইজান আবেদন করেছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, তারা সদস্যপদ পাবে কি না, সে বিষয়ে ডি-৮ মন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত নেবেন। এছাড়া নাইজেরিয়া কর্তৃক ডি-৮ ইয়ুথ কাউন্সিল গঠনের বিষয়টি আলোচনা করা হবে।
এনআই/জেডএস