মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত সব অপরাধের তদন্ত করতে পারবে দুদক
মুদ্রা পাচার, জালিয়াতি ও প্রতারণা সংক্রান্ত অপরাধ থেকে উদ্ভূত মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত সব অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান সংস্থাটির কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন : সরকারি এক সংস্থাই ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৪৬৮ কোটি টাকা
দুদক কমিশনার বলেন, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের এক আদেশে বলা হয়েছে, তফসিলভুক্ত যেকোনো অপরাধের বিষয়ে মানিলন্ডারিং আইনের আওতায় অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারবে দুদক। আগে মানিলন্ডারিং আইনের আওতায় শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট অপরাধ অনুসন্ধান করতে পারত সংস্থাটি। এখন থেকে সবগুলো অপরাধ অনুসন্ধান ও তদন্ত করার সুযোগ পাবে দুদক। কমিশন থেকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ২৭টি অপরাধের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারত দুদক। ২০১৭ সালে এ বিষয়ে মামলা ও হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ আছে। সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আরেটি মামলার পরিপ্রেক্ষিত হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন। আপনারা হয়ত বলবেন, মানিলন্ডারিং বিষয়ে পার্লামেন্টে আইন সংশোধন করা হয়েছে। হাইকোর্ট তার আদেশে সেটাও বলেছেন। আর সংবিধানের ১১১ ও ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুদককে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ আমাদের মানতেই হবে। আমরা মানতে বাধ্য।
এর আগে চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সব ধরনের অর্থপাচারের অপরাধ তদন্তের সুযোগ রেখে আইনের সংশোধন চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয় দুদক। যদিও এখন পর্যন্ত ওই চিঠির জবাব পাওয়া যায়নি।
২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অর্থপাচারসহ সম্পৃক্ত সব অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তের একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। পরে ২০১৫ সালে আইনটি সংশোধন করে ২৭টি অপরাধের মধ্যে কেবল ঘুষ ও দুর্নীতি থেকে উদ্ভূত মানিলন্ডারিং অপরাধ দুদকের আওতায় রাখা হয়। এর ফলে দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, জালিয়াতি ও প্রতারণা সংক্রান্ত অপরাধ থেকে উদ্ভূত মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অন্য সব অপরাধ দুদকের এখতিয়ারের বাইরে চলে যায়।
আরও পড়ুন : ‘এনআইডি সংশোধনে অযৌক্তিক দলিল চাওয়া যাবে না’
দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, অর্থপাচারের ৮০ শতাংশ পাচার হয় আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। বিদ্যমান মানিলন্ডারিং আইনে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করতে পারে না দুদক। অথচ মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অভিযোগের বড় দায় নিতে হয় দুদককেই। এ কারণেই তদন্ত ক্ষমতা পুনরায় ফিরে পেতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যমান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে শুধু একটির (দুর্নীতি ও ঘুষ) অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা রয়েছে কমিশনের। বাকিগুলো করছে সরকারের ৬টি সংস্থা, সিআইডি, এনবিআর, বিএসইসি, পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কাস্টমস ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। অথচ ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের শুরুতে সব সম্পৃক্ত অপরাধ থেকে উদ্ভূত মানিলন্ডারিং অনুসন্ধান ও তদন্তের একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ছিল দুদক।
দুদকের ক্ষমতা না থাকায় পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারস, পেন্ডোরা পেপারস, মালয়েশিয়ার মাই সেকেন্ড হোম প্রকল্প, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্থ পাচারের মতো অনুসন্ধান-তদন্ত করা যাচ্ছে না।
২০০২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। এ আইনে বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি মানি লন্ডারিং অপরাধ তদন্ত করতে পারতেন।
এরপর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০২ বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ ২০০৮ জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশের অধীন ১৭টি পেডিকেট অফেন্স থেকে উদ্ভূত সব মানিলন্ডারিং এককভাবে শুধু দুদক কর্তৃক তদন্তযোগ্য ছিল। এই অধ্যাদেশ বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০৯ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এ আইনেও সব মানিলন্ডারিং এককভাবে শুধু দুদক কর্তৃক তদন্তযোগ্য ছিল।
এরপর মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০৯ বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ ২০১২ জারি করা হয়। যা পরবর্তীকালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ হিসেবে জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১২ সালের সংশোধিত আইনে ১৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের পরিবর্তে ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধ প্রতিস্থাপন করা হয় এবং এসব অপরাধ এককভাবে দুদক কর্তৃক তদন্তযোগ্য করা হয়।
অর্থাৎ ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের শুরুতে সব সম্পৃক্ত অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র সংস্থা ছিল দুদক। ২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করা হয়।
ওই সংশোধনীর মাধ্যমে ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে শুধু একটি (ঘুষ ও দুর্নীতি) অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদককে। এটি ২০১৬ সালের ২১ জুন দুদক আইনে তফশিলভুক্ত করা হয়।
২৭ অপরাধের তদন্তে ৭ সংস্থা : মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ২৭টি পেডিকেট অফেন্স অনুসন্ধান-তদন্তের জন্য ৭টি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯ অনুসারে ওই ছয়টি সংস্থা তাদের ওপর নির্ধারিত পেডিকেট অফেন্সের অনুসন্ধান-তদন্ত করবে।
বিধিমালা অনুসারে ‘দুর্নীতি ও ঘুষ’ এই ১টি সম্পৃক্ত অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্ত ভার এককভাবে দুদককে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরকে ১টি ‘কর সংক্রান্ত অপরাধ’ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে ১টি ‘পুঁজিবাজার সংক্রান্ত অপরাধ (ইনসাইডার ট্রেডিং অ্যান্ড মার্কেট মানিপুলেশন)’ এককভাবে অনুসন্ধান-তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আর ‘মুদ্রা জালকরণ’, ‘দলিল দস্তাবেজ জালকরণ’, ‘চাঁদাবাজি’, ‘প্রতারণা’, ‘জালিয়াতি’, ‘অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা’, ‘অপহরণ, অবৈধভাবে আটকে রাখা ও পণবন্দি করা’, ‘খুন ও মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি’, ‘নারী ও শিশু পাচার’, ‘চুরি/ডাকাতি/দস্যুতা/জলদস্যুতা/বিমান দস্যুতা’, ‘মানব পাচার’, ‘যৌতুক’, ‘মেধা স্বত্ব লঙ্ঘন’, ‘সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থ জোগান’, ‘ভেজাল বা স্বত্ব লঙ্ঘন করে পণ্য উৎপাদন’, ‘যৌন নিপীড়ন’, ‘সংঘবদ্ধ অপরাধ’, ‘ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায়’- এই ১৮টি সম্পৃক্ত অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্ত ভার এককভাবে সিআইডিকে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া বাকি ৬টি সম্পৃক্ত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা যৌথভাবে দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো, ‘অবৈধ মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা’ এই সম্পৃক্ত যৌথভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও সিআইডি; ‘চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা’, বাংলাদেশ কাস্টমস ও সিআইডি; ‘চোরাকারবার’ এনবিআর ও সিআইডি; ‘দেশি ও বিদেশি মুদ্রা পাচার’, এনবিআর ও সিআইডি; ‘চোরাচালান ও শুল্ক সংক্রান্ত অপরাধ’ এনবিআর ও সিআইডি; ‘পরিবেশগত অপরাধ’- পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিআইডিকে যৌথভাবে অনুসন্ধান-তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আরএম/এসকেডি