পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) যান্ত্রিক সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আক্তিয়ারা বানুর সম্পদের হিসাব চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সোমবার (২৫ জুলাই) দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করার জন্য কমিশন নির্দেশনা দিয়েছে। 

শিগগিরই দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ থেকে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ ইস্যু করা হবে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। 

দুদকের অনুসন্ধানে তাদের রাজধানীর মিরপুরের পশ্চিম কাজিপাড়ায় দুই হাজার বর্গফুটের আয়তনের সাততলা বাড়ি, মিরপুরের মণিপুরে ছয়তলা বাড়ি ও দক্ষিণ মণিপুরে সোয়া ৫ শতাংশের ওপর একটি বহুতল ভবনের সন্ধান মিলেছে। 

এ ছাড়া মিরপুরের সেনপাড়ায় ১৫ শতাংশ জমি, কুষ্টিয়ায় সাড়ে ৩০০ শতাংশ জমির মালিকানাও পেয়েছেন 
অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম। 

আয়কর বিবরণীতে কাগজে কলমে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে রাখলেও দুদকের অনুসন্ধানে বড় ধরনের অমিল রয়েছে, যে কারণে অনুসন্ধান কর্মকর্তার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করার নির্দেশ দিয়েছে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) যান্ত্রিক সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযোগটি ভুয়া। দুদকে যখন অভিযোগটা দায়ের করা হয়, তখন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলাম। একটি শ্রেণি, বিশেষ করে এক জুনিয়র কর্মকর্তা আমার পদোন্নতি আটকানোর জন্য মূলত অভিযোগটা দায়ের করেন। তবে আল্লাহর রহমতে গত ডিসেম্বরে আমার পদোন্নতি হয়েছে। 

অবৈধ সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাড়ি কিংবা জমি, যা কিছু বলছেন তা এনবিআরে দাখিল করা আয়কর রিটার্নে দেখানো আছে। আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। সব সম্পদের হিসাব রয়েছে। দুদক কিছু পাবে না। 
 
দুদক সূত্রে জানা যায়, শহিদুল দম্পতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান পর্যায়ে দেশের ৫৭টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাজউক, দুই সিটি কর্পোরেশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসসহ শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শহিদুল ইসলাম, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে থাকা নথিপত্র তলব করেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা, যার অধিকাংশই হাতে পৌঁছেছে। অভিযোগ যাচাই-বাছাই করতে চলতি বছরের ১ মার্চ প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদও করে দুদক। 

দুদকের অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে

অনুসন্ধান ও তার আয়কর রিটার্নে দেওয়া তথ্যানুযায়ী শহিদুল ইসলামের নিট সম্পদের পরিমাণ দুই কোটি ২১ লাখ ছয় হাজার ২৫৯ টাকা। তার পারিবারিক ব্যয়, ঋণ পরিশোধ ও অন্যান্যসহ মোট ব্যয় পাওয়া গেছে এক কোটি ১৯ লাখ ৮৩ হাজার ৯২৩ টাকা। ব্যয় ও সম্পদের পরিমাণ যোগ করলে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার টাকা দাঁড়ায়।

অনুসন্ধানকালে তার গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায়, দুই কোটি ৬৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৮ টাকা। অর্থ্যাৎ ৭৬ লাখ ৪০ হাজার ৫৪ টাকার সম্পদ বেশি পাওয়া যায়। যার প্রকৃত আয়ের উৎস বৈধ নয় বলে সন্দেহ দুদকের।

অন্যদিকে প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের স্ত্রী আক্তিয়ারা বানুর নামে পাওয়া নিট সম্পদের পরিমাণ পাওয়া যায় তিন কোটি ছয় লাখ ৯৮ হাজার টাকা। পারিবারিক ব্যয়, ঋণ পরিশোধ ও অন্যান্য ব্যয় পাওয়া যায় চার কোটি ৫২ লাখ ৮৫ হাজার ২৪১ টাকা। সব মিলিয়ে মোট সাত কোটি ৫৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকার সম্পদ ও অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। অথচ দুদকের অনুসন্ধানে গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় পাঁচ কোটি ৫৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। সন্দেহজনক আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই কোটি তিন লাখ ১৬ হাজার টাকার বেশি। একজন গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও তার এত সম্পদের উৎস কী- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। 

প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর আয়কর নথিতে যা রয়েছে

প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী দুজনেই খুলনার ভেড়ামারা সার্কেলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের ২০১৯-২০২০ সালের আয়কর নথি অনুযায়ী বছরে তার মোট আয়ের পরিমাণ ১৭ লাখ ৫৯ লাখ ৮২৮ টাকা। এর মধ্যে গৃহসম্পত্তি থেকে আয় দেখিয়েছেন আট লাখ ৩৭ হাজার টাকা, যার বিপরীতে তিনি কর দিয়েছেন দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৭ টাকা। সম্পদের বর্ণনায় মিরপুরে সাত তলা বাড়ি অর্ধেকাংশ, মিরপুরে সেনপাড়ায় তিনভাগে প্রায় ২০ শতাংশ জমিসহ টিনশেট বাড়ি ও কুষ্টিয়ায় কৃষিজমিসহ মোট ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৯৬৫ টাকা মূল্যের সম্পদ। এ ছাড়া স্ত্রীর কাছে লোন ও ব্যাংক ঋণের কথা উল্লেখ করেছেন আয়কর রিটার্নে।

অন্যদিকে তার স্ত্রীর ২০১৯-২০২০ সালের আয়কর বিবরণী অনুসারে গৃহ-সম্পত্তি, কৃষি ও ব্যবসা থেকে আয় দেখিয়েছেন বছরে সাড়ে ১৫ লাখ টাকা। যার বিপরীতে প্রদেয় কর এক লাখ ৮৬ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। সম্পদের মধ্যে রয়েছে মিরপুরর কাজীপাড়ায় চার কাঠা জমিসহ ছয়তলা ভবন, মিরপুরে সাত তলা বাড়ির অর্ধেকাংশ, ১০ বিঘা কৃষি জমি ও ৮০ ভরি স্বর্ণালংকারসহ মোট ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকার সম্পদের বর্ণনা দিয়েছেন আয়কর রিটার্নে।

প্রকৌশলী শহিদুল দম্পতির যত সম্পদ

দুদক ও এনবিআর সূত্রে দেখা গেছে, প্রকৌশলী শহিদুল ও তার স্ত্রীর যৌথ মালিকানায় মিরপুরের দক্ষিণ মণিপুরে সোয়া পাঁচ শতাংশ জমি ও বহুতল ভবন এবং মিরপুর ৫৩৫/১ এ যৌথ নামে ৭ তলা বাড়ি (প্রতি তলা ১৯৫০ বর্গফুট) মালিকানা রয়েছে। যদিও সম্পদের দায় এড়াতে ২০২০ সালে তা কন্যাদের নামে দান করে দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে প্রকৌশলী শহিদুলের নামে মিরপুরের সেনপাড়ায় ১৫ শতাংশ জমির মালিকানা রয়েছে,  যা তিনি ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ক্রয়সূত্রে মালিক হয়েছে।

এ ছাড়া স্ত্রী আক্তিয়ারা বানুর নামে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন মিরপুরের পশ্চিম কাজীপাড়ায় সেনপাড়ায় ছয় তলা ভবনসহ ৬ দশমিক ৬০ জমি (বাড়ি নং ৮২৭/২/৫) ছিল, যার প্রতিটি ফ্লোর আড়াই হাজার বর্গফুটের। ওই ভবনও ২০১৯ সালে তাদের দুই মেয়েকে দান করেন। প্রকৃতপক্ষে শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আক্তিয়ারা বানুর অর্জিত সম্পদ মেয়েদের নামে দান করেছেন। এ ছাড়া আক্তিয়ারা বানুর নামে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ক্রয়সূত্রে প্রায় সাড়ে ৩০০ শতাংশ জমি মালিকানার অস্ত্বিত্ব পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে।

আরএ/আরএইচ