হালদায় অবৈধ জালে মারা পড়ছে বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন
চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে একের পর এক মারা পড়ছে বিপন্ন প্রজাতির মিঠাপানির ডলফিন। গত ৮ দিনে তিনটি মৃত ডলফিন ভেসে ওঠেছে হালদা নদী ও সংলগ্ন খালে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) পর্যন্ত (৪ বছর ১০ মাস) হালদা নদী থেকে ৩৮টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলফিন রক্ষায় এখন পর্যন্ত যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া প্রশাসনের মনিটরিং কমে যাওয়ায় জাল ফেলার প্রবণতা বেড়ে গেছে। যা বিপন্ন প্রজাতির এ ডলফিনের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
বিজ্ঞাপন
ডলফিন পানিতে বসবাসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানুষের মতোই ডলফিন ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, বাচ্চা জন্ম দেয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাচ্চাকে দুধ পান করায়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকাভুক্ত বিপন্ন প্রজাতির মিঠাপানির কিছু ডলফিন এখনো হালদা নদীতে রয়েছে। হালদা নদীতে যে ডলফিনের দেখা মেলে তা গাঙ্গেয় ডলফিন। স্থানীয়ভাবে শিশু, শুষ, হুস, হুতুম, শুশুক ও ডলফিন নামে পরিচিত। এটি বর্তমানে দেশের একটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী।
বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) সকালে নদীর রাউজান উপজেলার গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট এলাকায় সবশেষ মৃত ডলফিনটি পাওয়া যায়। এর আগে বুধবার (২০ জুলাই) বিকেলে আজিমের ঘাট এলাকায় আরেকটি বড় আকারের মৃত ডলফিন ভেসে আসে। ডলফিনটির ঠোঁটের নিচের অংশ বিচ্ছিন্ন ছিল। দাঁতগুলোও ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ডলফিনটির মুখ জালে আটকা পড়েছিল। তাই ছাড়িয়ে নিতে এভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া গত ১৪ জুলাই রাউজান পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ গহিরা এলাকায় হালদার সংযোগ খাল বুড়িসর্তা থেকে প্রায় সাড়ে ৮ ফুট দৈর্ঘ্যের ১২০ কেজি ওজনের একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়।
আরও পড়ুন : রিজার্ভের হিসাব নিয়ে আইএমএফের প্রশ্নের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত হালদা নদী থেকে ৩৮টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ৮ দিনে উদ্ধার করা হয়েছে ৩টি মৃত ডলফিন। ২০১২ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ( সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুসারে ডলফিনের এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
তিনি বলেন, ডলফিন রক্ষায় এখন পর্যন্ত যথাযথ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডলফিন রক্ষায় দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, প্রশাসনের মনিটরিং ব্যবস্থা কমে গেছে, ফলে হালদায় জাল ফেলে মাছ ধরার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ডলফিনগুলো জালে আটকে পড়ার পর মারা গেছে।
তিনি বলেন, হালদাকে ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা দরকার। মা মাছের সঙ্গে ডলফিনের একটি সম্পর্ক আছে। মা মাছ ও ডলফিন রক্ষার জন্য হালদা নদীতে মনিটরিং বাড়ানো দরকার। সরকারের মনিটরিং আরও কার্যকর করতে হবে।
আরও পড়ুন : সরকারি এক সংস্থাই ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৪৬৮ কোটি টাকা
তিনি বলেন, হালদা নদীতে বড় বড় বার্জ ও বালির ট্রলার চলে। এগুলোর আঘাতেও ডলফিন ও মাছ মারা যেতে পারে। এছাড়া হালদা থেকে ম্যানুয়ালি বালি উত্তোলন করা হয়। রাতেও চুরি করে বালু তোলা হয় বড় বড় ট্রলারে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গাঙ্গেয় ডলফিন বর্তমানে দেশের একটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী। পদ্মা- ব্রহ্মপুত্র- মেঘনা এবং সাঙ্গু- কর্ণফুলী-হালদা ও অন্যান্য কিছু নদীতে পাওয়া যায় এ প্রজাতির ডলফিন। এ ডলফিনকে প্রতি ৩০ থেকে ১২০ সেকেন্ডের মধ্যে একবার শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির উপরে উঠে আসতে হয়। ডলফিন চোখে না দেখার কারণে প্রতিধ্বনি তৈরির মাধ্যমে চলাচল করে।
তিনি বলেন, সারাবিশ্বে ডলফিন মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে কারেন্ট জাল। ডলফিন চলাচলের সময় জালের অবস্থান প্রতিধ্বনির মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারে না (জালের সুতা শব্দ তরঙ্গ শোষণ করে)। যার কারণে সহজে জালে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া হালদা নদী থেকে সর্বশেষ উদ্ধার করা মৃত ডলফিনের গায়ে কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল না। হালদা নদীতে ডলফিন মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে অবৈধভাবে মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত কারেন্ট জাল। জালে আটকা পড়ে ডলফিনের মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়াও ডলফিনের মৃত্যুর পেছনে খাদ্যের অভাব, দূষণ, পানির গুণাবলী পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনও দায়ী।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, হালদা নদীকে গাঙ্গেয় ডলফিনের বসবাস উপযোগী করতে হলে নদীতে অবৈধভাবে যেকোনো ধরনের জাল দিয়ে মাছ ধরা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। নদীতে অতিরিক্ত ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল বন্ধ করতে হবে। হালদা নদী ও এর শাখা খালসমূহকে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। হালদার যে স্থানে ও শাখা খালে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে, সেখান থেকে পলি অপসারণ করে হালদায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কমিউনিটি বেইজড ডলফিন ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে, যেখানে বনবিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ডলফিন ডাটাবেজ তৈরি করে নিয়মিত ডলফিনের সংখ্যা ও আবাসস্থল মনিটরিং করতে হবে। ডলফিন সংরক্ষণে আলাদা বিশেষজ্ঞ মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ -(ডলফিন ও তিমি আইন) -৩৭তম ধারা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
ডলফিন পানিতে বসবাসকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানুষের মতোই ডলফিন ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, বাচ্চা জন্ম দেয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাচ্চাকে দুধ পান করায়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকাভুক্ত বিপন্ন প্রজাতির মিঠাপানির কিছু ডলফিন এখনো হালদা নদীতে রয়েছে। হালদা নদীতে যে ডলফিনের দেখা মেলে তা গাঙ্গেয় ডলফিন।
চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন নদীতে মা মাছ নেই। তারপরও নদীর মাছ রক্ষায় নৌ-পুলিশসহ প্রশাসন কাজ করছে।
আর ডলফিনের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, ডলফিনের বিষয়টি দেখে বন বিভাগ।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, হালদায় কোনো ইঞ্জিন বোট চলে না। হালদা নদীর ডলফিন ও মা মাছ রক্ষায় হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা প্রশাসন এবং নৌ-পুলিশ কাজ করছে। বন বিভাগ তৎপর আছে।
তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে অনেক ডলফিন মারা যায়। আঘাতে ডলফিন মারা গেছে এটা কেউ কি দেখেছে? অনেক ডলফিন বয়সের কারণেও মারা যাচ্ছে। কোন বাচ্চা ডলফিন কি এখন পর্যন্ত মারা গেছে?
জেলেদের জালে আটকা পড়ে অনেক ডলফিন মারা যাচ্ছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নদীতে জাল ফেললে কি ডলফিন আহত হয়? আমি জানি না কারা এসব বলে। যারা এসব কথা বলে তাদের কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে? মনের মাধুরী মিশিয়ে এ রকম অনেক কথাই বলা যায়!
কেএম/এসকেডি